শৈশব ও বাল্য পেরিয়ে সংক্ষিপ্ত বয়ঃসন্ধির মধ্য দিয়ে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর যে দ্রুত, বাড়ন্ত ও পরিবর্তনশীল সময় তাকে কৈশোর বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF)- এর মতে, ১০ বছর ও ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে কৈশোর বলে। সে মতে কিশোর-কিশোরী হলো ১০ বছর ও ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি বয়সী ছেলে-মেয়ে। আর গ্যাং অর্থ দল। নির্দিষ্ট কিছু লোকের একটা দলকে গ্যাং বলে। গ্যাং শব্দটি সাধারণত অপরাধ বা নেতিবাচক কাজে জড়িত কোনো দল বা গ্রুপ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। অপরাধের সাথে জড়িত কিশোরদের প্রত্যেকটি দলকে কিশোর গ্যাং বলে।
কৈশোর মানব জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এসময়েই রচিত হয় জীবনের ভিত্তি। কিন্তু কিশোররা যখন বিপথগামী হয়ে অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন সেই অমিত সম্ভাবনাময় কিশোরটিই পরিণত হয় দেশ ও জাতির মহা আপদে। বর্তমানে কিশোর গ্যাং একটি ভয়ানক সামাজিক ব্যাধি ও মহা বিষফোড়ার নাম। প্রথম দিকে কিশোর গ্যাং কালচার রাজধানী ও বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সারা দেশে ভয়াবহভাবে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার। শহর, নগর ও গ্রাম সর্বত্রই সমান তালে গ্যাং কালচারের আধিপত্য। প্রতিটি জনপদেই তারা সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর লেখাপড়া না জানা ভবঘুরে কিশোর থেকে শুরু করে অভিজাত ঘরের কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে এ অভিশপ্ত কালচারে। বিশেষ করে রাজধানীর বড় শহরগুলোর অলিগলিতে কিশোর গ্যাং এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রতিদিনই তারা কোনো না কোনো অপরাধের কারণে পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। কিশোর গ্যাং কালচার শুরুতে আড্ডা কিংবা ইভটিজিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা এখন ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা, ভাঙচুর, দখলদারিত্ব, আধিপত্য বিস্তার এমনকি খুনখারাবি পর্যন্ত গড়িয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই নিরাপদ নয় তাদের কাছে। মোটকথা, কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ডে জনজীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ, শঙ্কিত ও আতঙ্কিত। কিশোর গ্যাং নামে মানুষ শকুনদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্যথা এ অপরিণামদর্শী গ্যাং সদস্যরাই বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে আঘাত হানতে পারে।
কিশোর গ্যাংয়ের কারণ :
কিশোর গ্যাং একদিনে কিংবা একক কোনো কারণে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বহুমুখী কারণ। সুশীল সমাজ, সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশ্লেষক, আইন বিশেষজ্ঞ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সচেতন নাগরিক সমাজ কিশোর গ্যাংয়ের উৎপত্তি ও কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন। যেমন—
(১) বড়ভাই-ছোটভাই কালচার : মানব সমাজে বয়সের ভিত্তিতে কেউ ছোট কেউ বড়। এই বড় ও ছোটদের সম্পর্কের ভিত্তি হলো পারস্পরিক সম্মান-শ্রদ্ধা, স্নেহ-ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতা। এ ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে আছে মানব সমাজ ও সভ্যতা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধুনা আমাদের সমাজে ‘বড়ভাই’ ও ‘ছোটভাই’ কালচার গড়ে উঠেছে। এ কালচারের ভিত্তি হলো অন্যায় আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অবৈধ স্বার্থসিদ্ধি যা কিশোর গ্যাংয়ের অন্যতম কারণ।
(২) সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব : আদর্শিক ভিত্তি ছাড়া নিছক পার্থিব স্বার্থের উপর কোনো সম্পর্ক টেকসই হয় না। স্বার্থে সামান্য আঘাত আসলেই কিংবা সামান্য মনোমালিন্য হলেই কথিত বড়ভাই ও ছোটভাইয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরে। শুরু হয় ছোট-বড় তথা সিনিয়র-জুনিয়রের দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বই পরিণামে আরেকটি কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম দেয়।[1]
(৩) বুড়ো গ্যাং : ছোটরা অনুকরণ প্রিয়। তারা বড়দের থেকে শেখে। আমাদের সমাজে বড়রা গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত। নামে-বেনামে তাদের অনেক গ্যাং আছে। বড়দের এসব গ্যাং কালচার দ্বারা তাদের ছোট অর্থাৎ কিশোররা প্রভাবিত হয়। এক পর্যায়ে তারাও গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে আসল গডফাদার হিসেবে রয়েছে এই ‘বুড়ো গ্যাং’। এরা নিজেরা কিশোর না হলেও কিশোরদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলে নানা অপকর্ম করায়। মূলত তাদের কারণে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না। আইনি বা অন্য কোনো ঝক্কি-ঝামেলা থেকে গ্যাং সদস্যদের রক্ষা করেন। রাজনৈতিক দলের মিটিং-মিছিলে লোক জোগান দেওয়াসহ এলাকায় দলীয় আধিপত্য বিস্তারে ‘কিশোর গ্যাং’-কে ব্যবহার করে এই ‘বুড়ো গ্যাং’। ‘বড়ভাই’ হিসেবে পরিচিত এসব ‘বুড়ো গ্যাং‘-এর দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যও বন্ধ হবে না। এসব বুড়ো গ্যাংয়ের মধ্যে ঢাকার সোহেল রানা গ্যাং বহুবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে।[2]
(৪) সামাজিক অসঙ্গতি : সামাজিক অসঙ্গতি মানুষের মনে ক্ষোভ ও দ্রোহ তৈরি করে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সমাজিক অসঙ্গতি ক্রমে বেড়েই চলেছে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে জন্ম নিচ্ছে কিশোর গ্যাং।
(৫) ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রভাব : প্রত্যেক সমাজের মানুষ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক আচরণ দ্বারা প্রভাবিত। আমরা ধীরে ধীরে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়, ভিনদেশি সংস্কৃতি আমদানি করতে নিজেরা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করছি। ফলে শিশু-কিশোররাও ভিনদেশিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। এক পর্যায়ে ভিনদেশি সংস্কৃতি ইচ্ছামতো তাদের আয়ত্তে চলে যাওয়ায় তাদের আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
(৬) হিরোইজম বা বীরত্ব প্রদর্শন : হিরোইজম বা বীরত্ব প্রদর্শন কিশোরদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তারা স্বাধীনভাবে বলতে চায়, স্বাধীনভাবে চলতে চায়, ভিন্ন কিছু করে দেখাতে চায়, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে চায়। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এ চাওয়াটাই যখন বাস্তবতা বর্জিত এবং শুধু আবেগ নির্ভর হয়ে পড়ে, তখন তা উচ্ছৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়। আবেগতাড়িত ও উচ্ছৃঙ্খল হিরোইজমই কিশোর গ্যাংয়ের অন্যতম কারণ।
(৭) অপরাধনির্ভর দেশি-বিদেশি সিনেমা : দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রচলিত নাটক-সিনেমায় দায়বদ্ধতার জায়গাটি খুবই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে অবাধ্যতা, অশ্লীলতা, অস্ত্রবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, ইভটিজিং, শঠতা, প্রতারণা, মাদকতা, নারীর বস্ত্রহরণ, খুনখারাবি এবং যৌনসুড়সুড়ি নির্ভর রগরগে দৃশ্য। এগুলো দর্শকদের অপরাধপ্রবণতাই বৃদ্ধি করছে। তারা নায়ক-নায়িকাদের অনুকরণে হিরো সাজার জন্য অপরাধ সংঘটনের প্রেরণা পাচ্ছে। সুতরাং প্রচলিত নাটক-সিনেমাও কিশোর গ্যাং তৈরির জন্য দায়ী।
(৮) সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের অভাব : সামাজিকীকরণ মানুষের জীবনব্যাপী একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজ জীবনের কাঙ্ক্ষিত আচরণ উপযোগী হয়ে গড়ে উঠে। শিশু একটি পরিবারে তথা সমাজে যেভাবে সামাজিক হয়ে ওঠে তাকে সামাজিকীকরণ বলা হয়। সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান বাহন পরিবার। এছাড়া স্থানীয় সমাজ, স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন উপাদান, সমবয়সী সঙ্গী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের অভাবে কিশোররা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে এবং কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(৯) ব্যর্থ প্যারেন্টিং : প্যারেন্টিং অর্থ সন্তান প্রতিপালন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সন্তান জন্মের পর থেকে তার অগ্রগতির প্রতি সজাগ থাকা হয় এবং মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি দিক দিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হয়। এককথায়, সন্তান প্রতিপালনে পিতা-মাতার দায়িত্ব কর্তব্যই প্যারেন্টিং। প্যারেন্টিং একটি ‘গোল্ডেন জব’, মহান ব্রত। এতে আছে প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, লক্ষ্য নির্ধারণ, প্রতিপালন, প্রশিক্ষণ ও প্রতিফলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ পিতা-মাতা প্যারেন্টিং সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা প্যারেন্টিং বলতে সন্তান জন্মদান ও সনাতনী পদ্ধতিতে তাদের বেড়ে উঠাকে বুঝে থাকেন। সন্তান কোথায় যাচ্ছে? কী করছে? কার সাথে মিশছে?— এব্যাপারে অধিকাংশ পিতা-মাতা খোঁজই নেন না। এ প্যারেন্টিং ব্যর্থতা কিশোর গ্যাংয়ের অন্যতম কারণ।
(১০) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, শৈথিল্য ও দলীয় লেজুড়বৃত্তি : যে কোনো অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট বলে অভিজ্ঞরা মনে করেন। তারা যদি যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করেন, তাহলে কিশোর গ্যাং তো দূরের কথা, ভয়ংকর যে কোনো অপরাধ নির্মূল করাও সময়ের ব্যাপার মাত্র। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর অপরাধ দমনে পুলিশের উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে শুধু তালিকা করেই দায় সারছে পুলিশ। পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে বলছেন, তালিকা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। রাজনৈতিক কারণেও অনেক এলাকায় কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। অনেক সময় পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গেলেই আসছে রাজনৈতিক নেতা তথা বড় ভাইদের থেকে অদৃশ্য বাধা।[3] সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা ও পরিচালিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সমীহ করে চলেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। অনেক ক্ষেত্রে বখাটে কিশোর গ্যাং সদস্যদের নির্দেশ মতো নিরীহ ও নিরপরাধ কিশোরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করার অভিযোগও ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। তাছাড়া, পুলিশের সোর্স হিসেবে যাদের ব্যবহার করে তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরাধীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে যা অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
(১১) দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য : বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাছাড়া অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। পুলিশের তথ্য মতে, ১১ লাখ পথশিশু কোনো না কোনো অপরাধের সাথে জড়িত। পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। তাছাড়া তারা রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং, শোডাউন, পিকেটিং, ভাঙচুরসহ নানা অপরাধে ব্যবহার হচ্ছে।[4] বিশেষজ্ঞদের মতে, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেকে গ্যাং কালচারের দিকে ধাবিত হয়।
(১২) শিশুর বয়স নির্ধারণ ও আইনের ফাঁকফোকর : কিশোর গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০-১১-১৯৮৯ কনভেনশন অব দ্য রাইট অব দ্য চাইল্ড সম্মেলনে শিশুর বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হয়। সে আলোকে শিশু আইন-২০১৩ আইনে শিশুর বয়স ১৮ বছর নির্ধারিত হয়েছে। শিশু আইন-১৯৭৪ এ শিশুর বয়স নির্ধারিত ছিল ১৬ বছর। বাংলাদেশের পেনাল কোডের-৮২ ধারা মোতাবেক ৭ বছরের নিচে কোনো শিশুর আইনবহির্ভূত ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। ঐ আইনে ৮৩ ধারা মোতাবেক বিচারকের দৃষ্টিতে ১২ বছরের কোনো শিশুর যদি ম্যাচুরিটি সনাক্ত না হয় সে ক্ষেত্রেও শিশুটি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না। ডিজিটাল যুগে ১৬-১৮ বছরের একজন কিশোর যথেষ্ট ম্যাচুরিটি লাভ করে। অথচ এরা যত বড় অপরাধই করুক না কেন তাদের শিশু আইনে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। ওই আইনে হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। ফলে তারা নানা অপরাধমূলক কাজ করেও আইনের সুবিধা ভোগ করছে।[5]
(১৩) মাদকের সহজলভ্যতা : মাদক এখন খুবই সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই তা পাওয়া যায়। মাদক সেবনের টাকার জন্য অনেকেই কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দেয়।[6] ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২’ এটিকে আরও সহজ করে দিয়েছে। এই নতুন বিধিমালার আলোকে ২১ বছরের বেশি বয়সীরা মদ খাওয়ার অনুমতি পাবে। এ বিধিমালার আলোকে কোনো এলাকায় ১০০ জন দেশি বা বিদেশি মদের পারমিটধারী থাকলে ওই এলাকায় অ্যালকোহল বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া যাবে।[7]
(১৪) পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় : একজন শিশুর প্রথম পাঠশালা তার পরিবার। বাবা-মা প্রথম শিক্ষক। যখন কোনো পরিবারে বিশৃঙ্খলা ও উচ্ছৃঙ্খলা দেখা দেয়, তখন থেকে তারা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হয়। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে বয়সে কিশোররা স্কুল-কলেজে থাকার কথা তখন তারা নেশায় বুদ হয়ে থাকে। এমন কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নেই যার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। মূলত পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই কিশোররা আজ বিপথগামী। যখন তাদের হাতে থাকার কথা কলম, তখন থাকছে অস্ত্র। এই পরিস্থিতির দায় পরিবার ও সমাজের। কারণ পরিবার সেই নৈতিকতার শিক্ষা দিতে পারেনি। আর সমাজের গুটিকয়েক লোক কিশোরদের ব্যবহার করছে। তাদের ছত্রছায়ায় কিশোররা অপরাধী হয়ে উঠছে।
(১৫) খেলাধুলা ও সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের সঙ্কোচন : শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ অগ্রণী ভুমিকা রাখে। শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবারের পরেই বেশি অবদান রাখে খেলার মাঠের সঙ্গী-সাথীরা। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে কংক্রিটের স্তূপে চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে শিশুর স্বাভাবিক জীবন। ঘরবন্দি শিশুর দৌড়ে বেড়ানোর, খেলার সেই মাঠই নেই। মেগাসিটি ঢাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে অন্তত ১ হাজার ৩০০টি খেলার মাঠ প্রয়োজন। অথচ ঢাকায় খেলার মাঠের সংখ্যা মাত্র ২৩৫টি। আবার ঢাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ স্কুলে কোনো খেলার মাঠ নেই। শহরাঞ্চল তো বটেই গ্রামেও শিশু-কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। পরিকল্পিত এবং অপরিকল্পিতভাবে নির্বিচারে খেলার মাঠ ধ্বংসের মাধ্যমে ধ্বংস হচ্ছে আগামীর সম্ভাবনাময় প্রজন্ম। ফলে শিশু-কিশোরদের সুস্থ-স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুষ্ঠু বিনোদন ব্যবস্থার অভাবে আজকের শিশু-কিশোরদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে গ্যাং কালচার, বাড়ছে হানাহানি, মারামারি।[8]
(১৬) বই পড়ার অভ্যাস ত্যাগ : বই জ্ঞানের ধারক। বই জ্ঞানের আলো। বইয়ের সাথে শরীরের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। বই শরীরকে সুস্থ রাখে। বই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফোকাস পাওয়ার বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, মানসিক ভারসাম্য তৈরি করে। বই পড়ার সময় মস্তিষ্ক সবচেয়ে অ্যাক্টিভ থাকে। শরীরের পেশিগুলোকে সচল করতে যেমন ব্যায়ামের বিকল্প নেই, বই পড়া হলো মস্তিষ্কের ব্যায়াম।[9] কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এদেশের শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে বইবিমুখ। কুরআন, হাদীছ, ধর্মীয় বই, গল্প, কবিতা, সাহিত্যের বই দূরে থাক তারা নিজের পাঠ্যবইও ঠিকমতো অধ্যয়ন করে না। এই বইবিমুখতা কিশোর গ্যাংয়ের অন্যতম কারণ।
(১৭) রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন : রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেশ পরিচালনার নীতি-নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অপরাধপ্রবণ ও বিপথগামী হয়, তখন ঐ জাতির পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাং সৃষ্টি, প্রতিপালন ও পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতার কথা সকল আলোচনা ও গবেষণায় উঠে এসেছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা উঠতি বয়সী ও বেপরোয়া এসব কিশোরদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়েদা নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারাই মূলত এসব গ্যাং পরিচালনা করে থাকেন। এর জন্য তারা প্রথমে বেপরোয়া কিশোরদের বিভিন্নভাবে একত্রিত করেন। এরপর নিজেকে ‘বড় ভাই’ হিসেবে দেখিয়ে তাদের জড়িয়ে দেন বিভিন্ন অপরাধে। পরে সেই অপরাধ থেকে নিজেই তাদের উদ্ধার করে বনে যান দয়ার অবতার ও ত্রাণকর্তা। এরপর নিজের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাদের দিয়ে গড়ে তোলেন গ্যাং। রাজনৈতিক মিছিল মিটিং থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় মূলত কিশোর গ্যাং প্রতিপালিত হয়ে থাকে।[10]
(১৮) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষক জাতি গড়ার মহান কারিগর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতির প্রশিক্ষণালয়। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি তো দূরে থাক নিজের অস্তিত্বও রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা করুণ। শিক্ষকের হাতে বই এর পরিবর্তে ফেসবুক। শিক্ষার্থীর হাতে বই, কলমের পরিবর্তে মারণাস্ত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন মানুষ গড়ার পরিবর্তে শিক্ষার্থী তৈরিতে ব্যস্ত। এগুলো এখন টাকা উপার্জন এবং সনদ তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। মানুষ তৈরির মহান কারিগররাও ‘শিক্ষা শ্রমিক’-এ পরিণত হয়েছেন। তারা পেটের দায়ে ছাত্র-অভিভাবক ও প্রশাসনের সব অনৈতিকতাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রশ্রয় দিচ্ছেন অথবা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। কারণ ন্যূনতম নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাদেরকে নানামুখী হয়রানি এমনকি খুনেরও শিকার হতে হচ্ছে। সেই সাথে কিছু শিক্ষকের নৈতিক স্খলন তো আছেই। এই ক্রমাবনতির জন্য রাষ্ট্রীয় নানা অনুশাসনও কম দায়ী নয়। মোটকথা, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আদর্শ জাতি গঠন এবং জাতীয় উন্নতি, অগ্রগতিতে অবদান রাখতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতা কিশোর গ্যাং তৈরির অন্যতম কারণ।
(১৯) পরীক্ষায় সহজে পাশের ব্যবস্থা : পরীক্ষা মূল্যায়নের একটি মাধ্যম। এখানে পাশ ফেল থাকা বৈচিত্র নয়। যারা পরিশ্রম করবে, অধ্যবসায় করবে তারা ভালো ফলাফল করবে। যারা অমনোযোগী হবে কিংবা শ্রমবিমুখ হবে তারা ফেল করবে। পরবর্তীতে আবার চেষ্টা করবে পাশ করার— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা প্রসাশনের সাথে যুক্ত কর্তা ব্যক্তিদের আচরণে মনে হয় তারা সবাই ‘ফেল’ শব্দটি তুলে দেওয়ার জন্য জিহাদ ঘোষণা করেছেন। শ্রেণিকক্ষে বিষয় শিক্ষককে, পরীক্ষার হলে কক্ষ পরিদর্শককে, বোর্ড থেকে খাতা বিতরণের সময় পরীক্ষককে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’-এর নামে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যথাযথ দায়িত্ব পালনের সম্ভাব্য পরিণতি। বুদ্ধিমান শিক্ষক তাই ফেল করানোর ঝুঁকি তো নিচ্ছেনই না; বরং পাশ দেখাতে যা যা করণীয় তার সবটিই করছেন। তাই নিজ প্রতিষ্ঠানে সারা জীবন ফেল করা ছাত্রটিও নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং বোর্ড পরীক্ষায় প্লাস পেয়ে শিক্ষকের সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে সাহস পায়। পরীক্ষার হলে বিষয়ের নাম লিখতে না পারা ছাত্রটি যখন ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা পায় তখন শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলা নিতান্তই বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। এভাবে পরীক্ষায় সহজ পাশ পদ্ধতি শিক্ষার্থীকে পড়ার টেবিল থেকে নিয়ে যাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের অন্ধকার জগতে।
(২০) মানবিক আচরণ এবং কাউন্সিলিংয়ের অভাব : মানবিক আচরণ মানুষকে সংশোধন হতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে যখন কোনো কিশোর বিপথে যায়, খারাপ সঙ্গে মিশে, অপরাধপ্রবণতায় লিপ্ত হয়, তখন তাদেরকে সবাই বাঁকা চোখে দেখে, এড়িয়ে চলে কিংবা সমালোচনা করে। এসব বিপথগামীদের হৃদয়ের কান্না শোনা, তাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা, কারণ উদ্ঘাটন করা এবং উত্তরণের পথনির্দেশ করার লোক নেই বললেই চলে। এই বাঁকা চোখে দেখা এবং এড়িয়ে চলা তাদের আরো বড় অপরাধী হতে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ এই কিশোরদের প্রতি একটু মানবিক আচরণই তাদেরকে সুপথে দিশা দিতে পারে।
(২১) নৈতিক শিক্ষার অভাব : নীতি সম্বন্ধীয় শিক্ষাই নৈতিক শিক্ষা। শিশু-কিশোররা সাধারণত পিতা-মাতা, বাড়ির বয়স্ক সদস্য, প্রতিবেশী, শিক্ষক, সহপাঠী, সঙ্গীদের কাছ থেকে নৈতিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয় এমন উচ্চতায়(!) পৌঁছেছে যে, শিশু-কিশোরদের সামনে আদর্শিক কোনো মডেল নেই। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা অনৈতিকতার পথে পা বাড়াচ্ছে। এছাড়া, নৈতিক শিক্ষার ভাণ্ডার হলো কুরআন ও হাদীছ। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবার, বিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চরমভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে কুরআন ও হাদীছের শিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষাকে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে কোমলমতি কিশোররা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাংয়ের ধরন ও কার্যক্রম :
বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং নামক সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় ২০১২ সালে। ২০১৭ সালে উত্তরার ট্রাস্ট কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির খুনের পর এদের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে। প্রথমে এদের কর্মকাণ্ড দলবেঁধে আড্ডাবাজি ও ইভটিজিং-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আস্তে আস্তে তাদের অপরাধজগৎ বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সংশ্লিষ্টসূত্রগুলো বলছে, ১০ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২০ বছর বয়সীরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। প্রতিটি গ্যাংয়ের আলাদা আলাদা নাম থাকে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ১০ থেকে ১৫০ জন পর্যন্ত সদস্য থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু গ্যাংয়ের সদস্যদের চলাফেরা, চুলের কাটিং, পোশাক একই ধরনের থাকে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে তাদের গ্রুপ খোলা থাকে। এসব গ্রুপের মাধ্যমেই তথ্য আদানপ্রদান করা হয়। একেকটি গ্যাংয়ের একজন দলনেতা থাকে। মূলত তার নেতৃত্বেই গ্যাং পরিচালিত হয়। আবার তাদের একজন পৃষ্ঠপোষক থাকে।
কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ স্কুলপড়ুয়া ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। তারা অধিকাংশ সময় দলবেঁধে চলে, দলবেঁধে আড্ডাবাজি করে। তারা দলবেঁধে দ্রুতবেগে মোটরসাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তারা স্কুল-কলেজ শুরু ও ছুটির সময় ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত (ইভটিজিং) করে এবং বিভিন্নভাবে ভয় দেখায়। তারা নারীদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে আপত্তিকর ছবি পাঠায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও শেয়ার করে, প্রকাশ্যে ধূমপান করে, যত্রতত্র মাদকদ্রব্য সেবন করে। তারা অকারণে মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করে, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়। চুক্তিতে মারামারি করে। ফুটপাত, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ও নতুন ভবন তৈরির সময় ভবন মালিকদের থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে। মহল্লায় নতুন ভাড়াটিয়া দেখলেই বিভিন্ন কৌশলে তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বাসার ভেতরে গিয়ে হেনস্তা করে (তাদের ভাষায় ভিটিং দেওয়া)। পরীক্ষার সময় বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় এদের দৌরাত্ম্য খুব বেশি দেখা যায়। ধর্মীয় উৎসব যেমন— ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, দুর্গাপূজার সময় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য থাকে চোখে পড়ার মতো। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানকে সামনে রেখেও তারা বেপরোয়া আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। তারা মাদকবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। যত্রতত্র হামলা ও ভাঙচুর চালায়, স্কুল-কলেজে বুলিং-র্যাগিং তাদের নিত্যকর্ম। কথায় কথায় তারা দেশীয় ও খুদে অস্ত্র প্রদর্শন করে। জবরদখল, হাঙ্গামা, জমি দখল, ছিনতাই, মাস্তানি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বোমাবাজি, অপহরণ, খুনখারাবিসহ নানা অপরাধে তারা জড়িত হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কী ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে তা মাত্র কয়েকটি রির্পোট দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কিশোর গ্যাং : কারণ, ধরন ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের পর)। মো. হাসিম আলী
কিশোর গ্যাংয়ের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড :
(১) মদের টাকার জন্য দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার জাজিরা গ্রামের দশম শ্রেণি পড়ুয়া শাকিলকে খুন করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।[1]
(২) টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গত এক সপ্তাহে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়েছে অন্তত ১৫ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী।[2]
(৩) তেজগাঁও মহিলা কলেজসংলগ্ন ১০ নং গলিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে ঢাকার গভর্ণমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আহসান হোসেন আলিফ।[3]
(৪) সম্প্রতি মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকার শাহীন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে কিশোর গ্যাং আশিক বাহিনীর সদস্যরা।[4]
(৬) ফরিদপুরের শহরতলির ধুলদি রেলগেট বাজার এলাকায় মেমার্স মল্লিক ট্রেডার্স নামের বড় ধরনের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল হামলা চালিয়ে দুজনকে কুপিয়ে জখম করে এবং ক্যাশ বাক্স থেকে ৬ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।[6]
(৭) নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌরশহরে এক কলেজছাত্রীকে ইভটিজিং ও নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় ২০-২৫ জন বখাটে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়।[7]
(৮) ঢাকার পল্লবীতে ২০২২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি কিশোর অপরাধীদের হাতে পরপর রায়হান ও জাহিদ নামে দুই ব্যক্তি খুন হন।[8]
(৯) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকার আধরিয়ায় ৮ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে চাঁদার টাকা না দেওয়ায় রাশেদ মিয়া নামে তেলের দোকানের এক কর্মচারীকে ছুরি মেরে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।[9]
(১০) ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বাবু নামে এক নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।[10]
(১১) রাজশাহীর গোদাগাড়ী সরকারি স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী সামিউল আলমকে কিশোর গ্যংয়ের সদস্যরা তুলে নিয়ে বেদম মারধর ও সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।[11]
দৈনিক ইনকিলাবের সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে রাজধানীতে কিশোর অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে প্রায় অর্ধশত। যার মধ্যে একটি মামলার বিচারকার্য চূড়ান্ত পর্যায়ে।[12]
অঞ্চলভিত্তিক কিশোর গ্যাং :
কিশোর গ্যাং মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে শহর, নগর, গ্রাম প্রতিটি জনপদে। তবে এই গ্যাংয়ের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা ও এর আশপাশে শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।[13]
ঢাকার উপকণ্ঠে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে ৬০টিরও বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে। উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যার প্রায় সবকটিই মাদক কারবারে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এছাড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা কিশোর গ্যাংয়ের কারণে বার বার পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে।
কিশোর গ্যাংয়ের বাহারি নাম :
কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ নামই ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট। এর বাইয়ের বেশ কিছু নাম আলোচনায় এসেছে। যেমন— তেজগাঁও এলাকার) ‘লাল গ্রুপ’, ‘টক্কর ল’, ‘ল ঠেলা’, ‘মুখে ল’ , ‘পাঁয়তারা কিংস’, দে ধাক্কা, লারা দে, লেভেল হাই, গুতা দে, মারা ভাণ্ডার, কালা আয়সা, ক্যাস্তা ফিরোজ ৪০ ফিট, ভাইগ্যা যা। (উত্তরা এলাকার) জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, বিগ বস, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, তালা চাবি, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েজ, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, এনএনএস, ইফএইচবি, রনো, কে নাইন, ফিফটিন, থ্রি গোল, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার। (নারায়ণগঞ্জ এলাকায়) সেভেন স্টার, ইয়াং স্টার, টাইগার, কিং স্টার, স্ট্রয় অ্যাটাক, কসাই, বাবা, গাল কাটা লাদেন, রগকাটা আকাশ, ফ্লেক্সি সাইফ, এলকে ডেভিল. ডেঞ্জার গ্রুপ, দাদা ভাই গ্রুপ ইত্যাদি। এসব উদ্ভট নামই কিশোর গ্যাংয়ের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
কিশোর গ্যাং প্রতিরোধের উপায় :
(১) নজরদারিতা : কিশোর অপরাধ বিশেষ করে কিশোর গ্যাং নির্মূলে সবার আগে প্রয়োজন নজরদারি। এক্ষেত্রে পরিবার, প্রশাসন, সমাজ, রাষ্ট্র সকলকেই সম্মিলিত ভূমিকা রাখতে হবে।
(২)পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি : পরিবার শিশুর সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সুতরাং কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে পরিবারের সকল সদস্যের সম্মিলিত প্রয়াস ও উদ্যোগের বিকল্প নেই।
(৩)সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি : পরিবারের পরই সমাজের দায়বদ্ধতার বিষয়টি আসে। সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আচার-আচরণ দ্বারা শিশু-কিশোররা প্রভাবিত হয়। সুতরাং সমাজের সচেতন মহল ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে সোচ্চার হলে কিশোর গ্যাং নির্মূল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
(৪)সামাজিক উদ্যোগ : কিশোর গ্যাংয়ের শক্তি ও রসদের যোগান আসে মূলত রাজনৈতিক মহল থেকে। তাই আইন বা পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে এগুলো বন্ধ করা কঠিন। সেক্ষেত্রে সমাজের ভেতর থেকেই বিপথগামী কিশোরদের সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন উপাদান যেমন সাহিত্য সংঘ, সমিতি, সাংস্কৃতিক সংঘ, খেলাধুলার ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব স্থাপন, মানবতার দেয়াল তৈরিসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগে কিশোরদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারলে কিশোর অপরাধ বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
(৫) প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণ : প্যারেন্টিং কোনো হেলাখেলার বিষয় নয়। এটি মহান ব্রত। প্যারেন্টিং-এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এদেশের অধিকাংশ পিতা-মাতাই অজ্ঞ। পিতা-মাতাকে প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণ প্রদান কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
(৬) খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংপৃক্ততা বৃদ্ধি : খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব কাজে কিশোরদের যুক্ত রাখলে অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা হ্রাস পাবে। সুতরাং কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও খেলার সামগ্রীর ব্যবস্থা ও সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা জরুরী।
(৭) বই পড়া : বই জ্ঞানের ধারক। বই জ্ঞানের ভান্ডার। বই পাঠের অভ্যাস মানুষকে দুশ্চিন্তা, অলসতা, অস্থিরতা থেকে মুক্তি দেয়। বইয়ের সাথে একবার সম্পর্ক হয়ে গেলে কিশোররা আর গ্যাং কালচারের দিকে ফিরেও তাকাবে না। সে কারণে পারিবারিকভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে পর্যাপ্ত সমৃদ্ধ পারিবারিক ও পাবলিক লাইব্রেরি।
(৮) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি : কিশোর গ্যাং দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই। তাদের কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে কিশোর গ্যাং নির্মূল করা সম্ভব। এজন্য তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার স্পেস দিতে হবে।
(৯) সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ : সামাজিকীরণ বাধাগ্রস্ত হলে শিশুর বিকাশ ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। আর সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণই পারে শিশু-কিশোরদের সব ধরনের অপরাধপ্রবণতার পথ রুদ্ধ করতে। তাই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের উপর জোর দিতে হবে।
(১০) কিশোরের সংজ্ঞা ও আইন পরিবর্তন : বর্তমানে কিশোররা পরিণত মানুষের মতোই আচরণ করছে। তাদের অপরাধের ধরন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বয়স্কদেরও হার মানাচ্ছে। সে কারণে শিশু আইনের দোহাই দিয়ে কিশোর অপরাধীকে ছাড় দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রয়োজনে শিশু আইন সংশোধন আনতে হবে।
(১১) কিশোর কারাগার স্থাপন : অপরাধী কিশোরদের জন্য পৃথক কোনো কারাগারের ব্যবস্থা নেই। সে কারণে তাদেরকে প্রকৃতার্থে সংশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না।
(১২) নৈতিক শাসন জোরদার করা : কিশোর অপরাধ নির্মূলে শুধু আইনী শাসনই যথেষ্ট নয়। আইনী শাসনের পাশাপাশি নৈতিক শাসনের মাধ্যমে কিশোরদের সুপথে ফেরানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে রাজশাহী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-২-এর বিচারক মুহা. হাসানুজ্জামান। তিনি অভিযুক্ত রাজশাহীর ২৬ শিশু আসামিকে ভালো কাজ করার শর্তে মুক্তির সুযোগ দিয়েছেন। সাজাপ্রাপ্তদের ভালো কাজ করার এই কার্যক্রম ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করার কথা আদেশে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এই ছয় মাস তারা নিজ নিজ বাড়িতেই থাকবে। যদি তারা আদালতের নির্দেশনা ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের শর্ত অনুযায়ী সুন্দর জীবনযাপন করে, তাহলে তাদের মামলা থেকে খালাস দেওয়া হবে। তবে যারা নির্দেশনা উপেক্ষা করবে তাদের আবারও বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া তাদের মাদকে না জড়ানো, বাল্যবিবাহ না করা, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, মারামারিতে জড়ানো থেকে বিরত রাখতে বলেছে আদালত। এসময় তাদেরকে ভালো কাজ করাসহ সমাজসেবা দপ্তর নির্ধারিত ১০টি শর্ত মেনে চলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ছয় মাস পর আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ঘোষণা করে।[14]
(১৩) প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ : Prevention is better than cure অর্থাৎ ‘রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’। কোনো অপরাধের পর তার কারণ ও ধরন নিয়ে গবেষণার চেয়ে জরুরী হলো ঐ অপরাধ সংঘটনের উৎস বন্ধ করা। প্রতিরোধমূলক এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে আক্রমণ ও সংক্রমণের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় থাকে। অপরাধের ক্রমবর্ধমান এই নবতর প্রবণতা রুদ্ধ করতে না পারলে এবং তা সমাজদেহে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়লে পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা বাস্তবপক্ষেই হুমকির মুখে পড়বে। তাই সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করা, আরও বৃহত্তর পরিসরে গবেষণা করা এবং কারণসমূহ উদ্ঘাটন করে প্রতিরোধে যথার্থ করণীয় নির্ধারণ করা।
(১৪) ইসলামী আইন বাস্তবায়ন : ইসলামী জীবনব্যবস্থা মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় একটি নেয়ামত। এতে রয়েছে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগের সমাধান। ইসলাম নির্দেশিত বিধানাবলি সামগ্রিক জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রদেহের সকল রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা চর্চার ব্যবস্থা হলে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করা গেলেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শান্তির আধারে পরিণত করা সম্ভব হবে এবং জাতি কিশোর গ্যাংয়ের মতো অভিশপ্ত অপরাধের বিষবাষ্প থেকে রক্ষা পাবে, ইনশা-আল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সামগ্রিক জীবনে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার এবং এর মাধ্যমে আমাদেরকে ইহ ও পরকালের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই সমাজে এই গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এদের কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাং আসলে কারা? কিশোর গ্যাং হচ্ছে ১৮ বছরের নিচে যেসব কিশোর দলবদ্ধভাবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা চালায়। দেখা যায়, ১৫ থেকে ১৬ বছরের কিশোররাই কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে।
কিশোর গ্যাংদের কাজ হচ্ছে মানুষকে উত্ত্যক্ত করা, মেয়েদের টিজ করা, বকাবকি করা, হুমকি দেওয়া, স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের উদ্দেশে বাজে কমেন্ট করা, ভয়ভীতি দেখানো, সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এই বখাটে কিশোররা পড়ালেখা না করে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তারা সাধারণত রাতে দলবদ্ধভাবে নেশাদ্রব্য পান করে। এতে তারা উগ্র হয়ে ওঠে। আমাদের করণীয় হলো, সামাজিক সচেতনতা তৈরি করে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা। কিশোররা যেন কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত না হয় তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমাদের সমাজে, পাড়া-মহল্লায় যেসব প্রভাবশালী রয়েছেন, তাদের উচিত কিশোর গ্যাংয়ের উগ্র সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া। যেখানেই কিশোর গ্যাং দেখা যাবে, দ্রুত তাদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অর্পণ করতে হবে। তাদেরকে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করতে হবে। কিশোর গ্যাং যে পরিবার থেকে গড়ে উঠবে, সেই পরিবারকে সচেতন করতে হবে। কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সচেতনামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। বিচার, সালিশি ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। কিশোররা যেন ‘ঘরের রোগ’ না হয়ে ঘরের আলো হয়ে ওঠে। কিশোররা যেন আগামীর কলঙ্ক নয়, আগামীর ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারে। তাদের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা, যত্ন বাড়াতে হবে।
একসময় আমাদের কাছে কিশোর গ্যাং নামে কোনো পরিচিত শব্দ ছিল না। আমরা বলতাম কিশোর অপরাধ, যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন কিশোর কিংবা অল্পসংখ্যক কিশোর কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত হতো। এদের অপরাধের ধরনও ছিল ছোটখাটো চুরি কিংবা হৈ-হল্লা করা। কারো বাগান থেকে কোনো ফল চুরি করে খাওয়া ইত্যাদি।
বড় কোনো অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা একেবারেই ছিল না। নব্বইয়ের দশকে কিংবা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সময়ের কথা বলছি। শিশু-কিশোরদের এহেন অপরাধ মোকাবেলায় সমাজের বয়স্ক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ব্যক্তি ও সমাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত সংঘ ও তাদের ভূমিকা যথাযথ ছিল বিধায় শিশু-কিশোররা অনেকটা ভয়ে বড় কোনো অপরাধ করতে সাহস পেত না।
এ ছাড়া সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ ও তার অনুসরণ এদের ওপর বড় প্রভাব বিস্তার করত।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুর আজ পরিবর্তন হয়েছে। আমরা কিশোর অপরাধ না বলে এখন কিশোর গ্যাং বলছি। কেননা আজ কিশোররা একত্র হয়ে সংঘবদ্ধভাবে এমন সব অপরাধ করছে, যা বয়স্কদের অপরাধকেও হার মানায়।
আজকে তারা সংঘবদ্ধ। বিভিন্ন এলাকা, পাড়া কিংবা মহল্লায় তাদের আলাদা নাম রয়েছে। তারা ঐক্যবদ্ধ। একসঙ্গে অনেকগুলো বাইক নিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করে তারা চলাচল করে। তাদের চলাচল সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষ করে রাস্তাঘাটে শিশু ও বৃদ্ধরা আজ তাদের কর্মকাণ্ডে বেশিমাত্রায় অতিষ্ঠ। ফলে অপরাধের ধরন বিবেচনায় কিশোর অপরাধ আর অন্য অপরাধকে আমরা আলাদাভাবে দেখতে পারছি না। শুধু ছোটখাটো অপরাধ নয়, কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাউকে হত্যা করতেও তাদের বুক কাঁপছে না। আমাদের উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। তাদের মোকাবেলা করার জন্য মাননীয় হাইকোর্ট সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে দাবি করছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা কোনো অপরাধের সংজ্ঞায়ন, ধরন খুঁজে বের করা, কারণ বিশ্লেষণ, বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা কয়েকটি বিষয়কে কিশোর গ্যাংয়ের জন্য দায়ী বলে মনে করি। কিশোর গ্যাংকে কোনো একক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ নেই। পবিরার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, আইন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
প্রথমেই পরিবার থেকে শুরু করি। আমাদের পারিবারিক শিক্ষা আর আগের মতো নেই। আমরা কেউ কেউ সন্তানদের সঠিক মূল্যবোধ শেখাতে পারছি না আবার অনেকে শেখাতে চেষ্টাও করছি না। ফলে শিশু-কিশোররা সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে বড় হতে পারছে না। পরিবারের বাইরে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সংঘ ও সংগঠনের ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নিত্যনতুন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় গড়ে উঠছে, কিন্তু সেগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। শিশুর যত্ন ও সামাজিকীকরণে এদের ভূমিকা আজ নগণ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু সস্তা বিনোদন ও বলয় তৈরি এবং নেতৃত্ব জাহির করা এখনকার কাজ। এগুলোতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের নিয়ে আমাদের বড় প্রশ্ন রয়েছে। নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে বর্তমানে রাজনৈতিক পরিচয়কে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। ফলে একান্ত ভালো মন নিয়ে কাজ করার মানুষগুলো আজ নিজেদে গুটিয়ে নিচ্ছে। জায়গা পূরণ হচ্ছে কাউকে না কাউকে দিয়ে। কিন্তু তারা শিশু-কিশোরদের দিয়ে ভালো কাজ করা কিংবা তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পরিবর্তে শেখাচ্ছে পারস্পরিক রেষারেষি এবং নিজেকে জাহির করার মানসিকতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও আজ অসহায়। কেননা কোনো শিক্ষার্থীর অন্যায় কাজ কিংবা আচরণ প্রতিরোধ করতে গেলে তাঁদেরও জীবনহানি ঘটতে পারে এবং অতীতে ঘটেছে। বাকি থাকল আমাদের আইন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তারা যদি নিজের মতো করে কোনো চাপের বাইরে থেকে কাজ করতে পারত, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হতো।
সমাজে ব্যক্তির কাছে আশপাশের কিছু মানুষ প্রচলিত ধারা, বিধি ও আইনকানুন সম্পর্কে এমন ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে যে ব্যক্তির কাছে মনে হয়, আইনকানুন মেনে চলাই শ্রেয়। আবার সমাজে অন্য কিছু মানুষ রয়েছে, যারা অন্যভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করে; তখন ব্যক্তি মনে করে, আইনকানুন না মেনে চলাই শ্রেয় কিংবা মেনে চলার দরকার নেই। সমাজের মানুষগুলো দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত যুক্তি উপস্থাপন করে এবং দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে আইন মেনে না চলতে পর্যাপ্ত সাহস নিয়ে থাকে। এমনও বলতে শোনা যায়, আমরা তো আছি তোমার কোনো ভয় নেই। বলা যায়, আইন ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ ও সংস্কৃতির একটি প্রভাব রয়েছে। চলমান কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষেত্রে এই মতবাদটি বেশি প্রযোজ্য।
সমাজে বসবাসরত কোনো না কোনো ব্যক্তি, যিনি হতে পারেন রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তি, হতে পারেন কোনো সামাজিক সংগঠনের নেতা কিংবা অন্য কেউ। যিনি বা যাঁদের সংস্পর্শ ছাড়া শিশু-কিশোরদের সংঘবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। শিশু-কিশোরদের নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট নেতৃত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তাদের ওপর বড় প্রভাব বিস্তার করছে কোনো না কোনো বড় নেতা বা নেতাগোষ্ঠী। তাদের বিবেচনায় না এনে শিশু-কিশোরদের দমন করা ও কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিশোর গ্যাংয়ের বর্তমান হার ও ভয়াবহতা চলমান থাকার অর্থ ভবিষ্যতে আমাদের অপরাধজগতের মাত্রা অসম্ভব পরিমাণে বৃদ্ধি এবং তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করা।
আমাদের বেশ কিছু করণীয় আছে। পারিবারিকভাবে সন্তানদের সঠিক মূল্যবোধ শেখানো এবং তাদের চলাফেরার প্রতি গভীর নজর রাখা একান্ত দরকার। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক ভূমিকা পালনের প্রতি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। খারাপ ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রভাব থেকে শিশু-কিশোরদের আলাদা করার কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করুন। কোনো বলয় তৈরি এবং শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে নয়। আমরা যদি এই কাজটি না করতে পারি, তাহলে কোনোভাবেই কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কাজ করতে হবে। তাহলে আমরা কিশোর গ্যাং মোকাবেলা করতে পারব।
সম্প্রতি পটুয়াখালীর বাউফলে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে দশম শ্রেণির দুই মেধাবী শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং আরও একজন গুরুতর আহত হয়েছে। সারা দেশেই উঠতি কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা পাড়া-মহল্লা, বাজারের অলিগলিতে আড্ডা এবং বিভিন্ন সময় তারা অপরাধ ঘটিয়ে আলোচিত সমালোচিত হয়। এসব অঘটনের পর বিব্রত হয় স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অভিভাবক।
বখাটে কিশোর গ্যাং কালচার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দিনভর বখাটেরা আড্ডায় মেতে উঠে। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-অলিগলিতে বখাটে ও কিশোর গ্যাংস্টারের উপদ্রব উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। কিশোর গ্যাংস্টাররা অপরাধ কর্মকান্ডে বেপরোয়া হয়ে উঠায় অনিরাপদ হয়ে উঠেছে জনজীবন। প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করতে গিয়ে খুন-খারাবির মতো ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিশোরদের গ্যাং কালচারের উৎপাত নিয়ে বেশ বিব্রত ও উদ্বিগ্ন।
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও বয়সই আঠারোর বেশি নয়। কেউ পড়াশোনা করে, কেউ ব্যবসা করে, আবার কেউ কিছুই করে না। বেপরোয়া তাদের স্বভাব, কথাবার্তা ও চলাফেরাও বেশ উগ্র। এলাকায় নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা দল বেঁধে চলে। ইভটিজিং থেকে শুরু করে এই কিশোররা জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমূলক কাজে। এরই মধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবনকে রঙিন করতে, না বুঝে অনেকেই পা বাড়ায় এ ধ্বংসের পথে।
মূলত কিশোর গ্যাং শহরের অলিগলিতে চায়ের দোকান বা বিশেষ কিছু স্থানে অবস্থান নেয়। তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত সংগঠিত হচ্ছে নানা অপরাধ। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চুরি, ইয়াবা সেবন, ছিনতাই, মদ বিক্রি ও সেবন, জিম্মি রেখে টাকা আদায়সহ ভয়ংকর সব অপরাধ করে বেড়ায় কিশোর গ্যাং বা সন্ত্রাসী গ্রুপ। বখাটেপনা বা কিশোর গ্যাং অপরাধ দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে শহরে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার উপায় না থাকায় অভিভাবকরা চরম শঙ্কিত।
কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা নিরসনে সর্বপ্রথম এর কারণ চিহ্নিত করা দরকার। অনেকে বলছেন- পারিবারিক সুশিক্ষা ও নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এর জন্য মূলত দায়ী। এক্ষেত্রে পরিবারকে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে। পরিবারে কিশোরদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে পিতা-মাতাকে। সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় সময় কাটায়- এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটর করতে পারলেই গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব। এর বাইরে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো পারিবারিক নৈতিক সুশিক্ষা। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা- এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালন-পালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।
যেসব কাজ প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, প্রচলিত আইন ভঙ্গকারী ওই ধরনের কাজ অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হলে সেটিকে কিশোর অপরাধ বলা হয়।
কিশোর বয়সের চাহিদা হলো নিজেকে প্রকাশ করা। আত্মপ্রকাশের চাহিদা তাদের কৌতূহলপ্রিয় করে তোলে। কৌতূহলের বশে তারা নতুন কিছু জানতে চায়, শিখতে চায়। এ স্বতঃস্ফূর্ত আকাক্সক্ষাকে যদি মা-বাবা, শিক্ষক ও অভিভাবক সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন, তবে এ ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যৎ জীবনে, কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে সফল মানুষ হয়। এ ছাড়া কিশোরদের অপরাধী হওয়ার নেপথ্যে আরও কিছু স্বভাবগত কারণ রয়েছে, যেমন মা-বাবার অযতœ-অবহেলা, উদাসীনতা, স্নেহহীনতা, সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদানে অমনোযোগিতা, পারিবারিক পরিমণ্ডলের ঝগড়া-বিবাদ, দারিদ্র্য, সুষ্ঠু বিনোদনের সংকট, সামাজিক অসাম্য, দুঃখ-দুর্দশা, যথাযথ তদারকির ঘাটতি, অবিচার, অশৈশব দুর্ব্যবহার প্রাপ্তি, কুসংস্কার ও কুসঙ্গ, অতি আদর, আর্থিক প্রাচুর্য ও অনিদ্রার মতো বিষয়গুলো কিশোরদের অপরাধী করে তোলে।
কিশোর অপরাধী হলো সেসব কিশোর-কিশোরী, যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজবিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণ ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মা-বাবার সঠিক নজরদারির অভাবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপনের ফলে ছেলেমেয়েরা বখে যাচ্ছে। ফলে ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি এবং অপরাধ করতে করতে পরবর্তী সময়ে তারা বড় অপরাধ করে বসছে। আবার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে চলতে চলতে মজার ছলে কিছু একটা করে বসে, যা পরবর্তী সময়ে বিরাট আকার ধারণ করে। এসব ছোট অপরাধ যদি শুরুতে সাবধান করা যেত তাহলে অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসত। সামাজিক সমস্যা হিসেবে এবং অপরাধ জগতে কিশোর অপরাধ ক্রমবর্ধমানশীল। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, কভিডকালেও ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৮ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ঘটনা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা শহরের ১০টি থানায় ৩২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে এবং ৫০০-৫৫০ জন সক্রিয় সদস্য ঢাকা শহরে নানারকম অপরাধ সংঘটিত করছে। তাদের মধ্যে উত্তরায় আদনান হত্যা, দক্ষিণখানে মেহেদী হত্যা এবং শেওড়াপাড়ায় সজীব হত্যা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন ও ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলা আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশিরভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে।
দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচারব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশুনীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এরপর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করে। পরিচালকের (প্রতিষ্ঠান) নেতৃত্বে অতিরিক্ত পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক সদর দপ্তর পর্যায়ে এবং মাঠপর্যায়ে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জেলা পর্যায়ের ৩ জন উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক মাঠ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং মাঠ পর্যায় ও সদর দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি শিশু (কিশোর/ কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক উক্ত কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের গাজীপুরের টঙ্গীতে বালকদের জন্য ৩০০ আসনের জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, কোনাবাড়ীতে বালিকাদের জন্য ১৫০ আসনের জাতীয় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র এবং যশোরের পুলেরহাটে বালকদের জন্য আরও ১৫০ আসনের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে।
কিশোর অপরাধ দমনে সরকার বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। অপরাধের ধরন বিবেচনায় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সেল গঠন করা হয়েছে। যেন অতি দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপরাধের শাস্তি এবং প্রতিকারে কী করণীয়, তা প্রচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ যানবাহনে নৈতিকতার শিক্ষা প্রচার করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল-কলেজের সামনে বিভিন্ন বিলবোর্ডের মাধ্যমেও তা প্রচার করা যেতে পারে।
আমাদের বর্তমান সমাজে পাঠাগার, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রম কমে গেছে এবং তাকে দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন ও আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কারণে কিশোর অপরাধ রোধ করার দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ স্কুলব্যবস্থার ওপর পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার, যা বিদ্যালয়গুলোকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশুকিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই ওই গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশুকিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মনমানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই সন্তানের অবসর সময় কীভাবে কাটছে, তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবেই কিশোর অপরাধ সংঘটনের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।
সমাজে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা আমাদের মধ্যকার সৌহার্দ, সম্প্রীতি, ঐক্য এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রধান উপাদানগুলোকে ক্রমেই গ্রাস করছে। সমাজ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। কার্যত সমাজের অচলায়তন ও অধঃপতনের ক্রমধারা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। যদি আমরা এখনই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, বলাই বাহুল্য যে এর খেসারত অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে। বলছি, নব্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সমস্যা ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে। এই সমস্যা এতটাই গুরুতর যে, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন! সরকারপ্রধান সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ‘ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে কিশোর গ্যাং মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রশংসার দাবিদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু তারপরও রোধ করা যাচ্ছে না।
ঢাকার একটি এলাকায় পূর্বে কিশোর গ্যাং লক্ষ করা যায়। এখন সেই কিশোর গ্যাং ঢাকায় প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়েছে। সারাদেশে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কিশোর গ্যাং, যারা মানুষ হত্যাসহ প্রায় সব অপরাধের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। তবে বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মূলত রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণেই উদীয়মান কিশোররা বেপরোয়া হয়ে পড়ছে।
অতীতে একটা সময়ে সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার ও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ভূমিকা ছিল। তারা কিশোরদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে প্রশ্রয় দিতেন না। এখন মুরব্বিদের হারানোর জায়গাটি নিয়েছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সুবিধাবাদীরা। তারা কিশোরদের ব্যবহার করেন। ‘বড় ভাই’ নামে সমাজে পরিচিত তারা। যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, চাঁদা তোলা এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্য কিশোরদের ব্যবহার করে। আবার এই অর্থের একটা অংশ কিশোরদের জন্য ব্যয় করা হয়। এই কিশোর অপরাধীরা পরবর্তীতে হয়ে যায় সন্ত্রাসী। তবে এই সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই, আছে বড় ভাইদের ছত্রছায়া। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘কিশোর গ্যাং’ প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য কিশোর গ্যাং পরিস্থিতির ভয়াবহতা জানান দিচ্ছে। পুলিশের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, সারাদেশে ১৭৩টি ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৮০টি। এবং এসব মামলায় প্রায় ৯০০ জন আসামি আছে। ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৭টি। ২০২২ সালের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের দেড় বছর অতিক্রম করেছে। এই সময়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গত ১০ এপ্রিল, ২০২৪ চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের কবল থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হন একজন চিকিৎসক। এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে ৫ থেকে ১৫ জন সদস্যের অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। নগরজুড়ে এদের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০। ২০২৩-এর জুলাই থেকে চলতি বছরে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ২০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার করেছে র?্যাব-পুলিশ। বর্তমানে বিচারাধীন ২ হাজার ২৩২টি মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত।
পুলিশের অনুসন্ধানের বাইরেও ঢাকায় আরো ১৪টি সক্রিয় কিশোর গ্যাং আছে। ২০২৩ সালে যাদের হাতে শুধু ঢাকাতেই ২৫ জন নিহত হয়েছেন। ২০২২-২৩ দুই বছরে তাদের হাতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে (ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ)। ঢাকার অদূরে সাভারেও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে। চলতি বছর মার্চ মাসে সেখানে ৪টি খুনের ঘটনায় সরাসরি সংশ্লিষ্টতা মিলেছে কিশোর গ্যাংয়ের। অর্থাৎ এদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অপরাধ প্রবণতার সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। নাম কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর সদস্যরা বেশির ভাগই ১৮ বছরের বেশি বয়সি। ২০২৩ সালে রাজধানীতে সংঘটিত ২৫টি খুনের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদের বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে রয়েছে- ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে ভাড়া খাটা, উত্ত্যক্ত করা, হামলা মারধর ও খুন। হিরোইজম এবং আধিপত্য ধরে রাখতেও বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ, বিবাদ ঘটে হরহামেশাই।
যে কোনো সমস্যা নিরসনে সেটার মূলে যাওয়াটা জরুরি। এই যে গ্রেপ্তার, মামলা ও অভিযান চালিয়েও কিশোর গ্যাং সংখ্যা কমছে না, বরং নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। এমনকি গ্রেপ্তারে সহায়তাকারীর ওপর অভিযুক্তরা কর্তৃক হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ উদঘাটন করাটা এখন জরুরি। আমরা সমস্যাকে গুরুত্ব দিই ভালো কথা, কিন্তু সমস্যার গভীরে গিয়ে তা মূলোৎপাটনের উপায় বাতলে দেয়ার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু কিছু সংবাদ মাধ্যমে কিশোর গ্যাং অভিযুক্তদের ছবি ছাপিয়ে এবং টেলিভিশন চ্যানেলে ঘটনাগুলোর ভিডিও দেখানো হচ্ছে। এটা সমাধান কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাযথ উপায় নয়। এ ধরনের বিষয়গুলো প্রতিরোধে নিতে হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যেমন অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে, সেটা বরং গণমাধ্যমে প্রচার করা জরুরি। তাহলে অপরাধীরা বুঝতে পারবে যে, তাদের পরিণতি কী হতে পারে।
যে কোনো সামাজিক সমস্যায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগ। এই সময়ে শিশু-কিশোররা অনলাইনে অনেক কিছু দেখে, যার ভেতর নেতিবাচকতা বেশি এবং তারা সহজেই সংগঠিত হয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শরীর চর্চা, খেলাধুলার সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চা থাকলে কিশোর-তরুণরা অপরাধ ও মাদক থেকে দূরে থাকে। আমাদের সেই ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। পথশিশু ও অভিভাবকহীনদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় এনে সুশিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে সুফল মিলবে। কারণ ভালো নাগরিক হতে তাদের শিক্ষা ও ভালো পরিবেশ দরকার। এক্ষেত্রে শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে পারে।
আমি নিজে ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে ধূমপান ও মাদকবিরোধী কথা বলেই যাচ্ছি। একটা সময় বিষয়গুলোকে পাত্তা দেয়া হতো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। দেশে তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’ এবং ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ গঠন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে।
কিছু ছোট বিষয় থাকে; কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধূমপান ও মাদক গলার কাঁটা হয়ে গেছে কিশোর-তরুণদের জন্য। কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি এবং প্রায় সব সামাজিক অপরাধের মূলেই রয়েছে মাদক, যার শুরুটা হয় মূলত ধূমপান থেকে। দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। অপরদিকে মাদকাসক্তির বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ধূমপান। ধূমপান হচ্ছে মাদকের রাজ্যে প্রবেশের মূল দরজা।
যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়ায়। বৈশ্বিকভাবেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশির ভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপার্শ্বিক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। এমনিতেই তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। উপরন্তু নাটক, সিনেমায়ও তরুণদের আইডল ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক, নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে, মাদকে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য অহরহ প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে ভিন্ন দৃষ্টির কথা বলেছেন সেটার একটা দিক হচ্ছে প্রতিরোধ। যারা এই অপসংস্কৃতির সঙ্গে জড়ায়নি তাদের দূরে রাখা এবং জড়িতদের শোধরানোর সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে তার খোঁজ রাখা অভিভাবকদের অত্যাবশ্যকীয় কাজ। সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা এবং ধর্মীয়, নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা, যা পরিবার থেকে একটি শিশুর ভিত্তি গড়ে দিতে সক্ষম। রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দেয়া এবং তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ করা জরুরি। নীতি বাস্তবায়নে তাদের সার্বিক সম্পৃক্ততা ও সুফল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে যোগ্য নেতৃত্বের শঙ্কা যেন না থাকে, সে দিকটাতে আশু সুনজর দেয়া অপরিহার্য। কিশোরদের মধ্যে ‘গ্যাং অপসংস্কৃতি’ দূর করতে হবে। এজন্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক মনন বিকাশে পরিবার, সমাজ সরকারি সব পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নতুবা এর পরিণাম থেকে আমরা কেউ মুক্ত থাকতে পারব না। তাই আসুন, আমরা এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করি।
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে ‘উক্তিটির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় আজকে যে শিশু, কাল সে শিশুই পরিণত হয়ে পরিবারের, সমাজের, দেশের, জাতির কর্ণধার হবে এবং তাকে শিশুকাল পেরিয়েই পড়তে হয় কিশোরজীবনে, আর এখানেই জীবনের গতিপথে বাঁক নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং নামক একটি সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে ২০১০ সালের পর থেকে উল্লেখ্য ২০১৭ সালে ঢাকার উত্তরায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির খুনের পর এদের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে এবং সঙ্গে সঙ্গেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসে এবং প্রতিরোধে তৎপর হয় ও মাঠে নামে।
রোববার ৩ মার্চ ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধন উপলক্ষে ভাষণ দানকালে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বক্তব্য দানকালে সমাজে কিশোর গ্যাং সমস্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে প্রতিটি পরিবারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কারও ছেলেমেয়ে যেন কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে না পারে, শুধু গ্রেপ্তার করে লাভ নেই, সচেতন হতে হবে, তাই গোড়া থেকে ধরতে হবে যখন ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে তখনই এ সমস্যাটি দেখা দেয়, এটি কোভিড ১৯ চলাকালিন সময়ে বিস্তার করেছে এবং এই সময়ে এটি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে। পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর সারা দেশে সর্বস্তরে এই সমস্যা নিরোধের জন্য ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
পুলিশ বিভাগের নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে ২০১২ সালে যেখানে কিশোর অপরাধে ৪৮৪টি মামলায় ৭৫১ জন আসামি ছিল, সেখানে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসেই ৮২১টি মামলায় ১ হাজার ১৯১ জন শিশু-কিশোর আসামি হয়।
২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ঢাকা ও এর আশপাশে ১২টি এবং সারা দেশে কমপক্ষে ৩৫টি কিশোর গ্যাং ছিল- খবরটি ২০২০ সালে ১৭ নভেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।
তবে বর্তমানে রাজধানীতে এ ধরনের ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কমপক্ষে ১০০টিরও বেশি এবং সদস্যসংখ্যা চার হাজারের বেশি বলেই জানা যায়, উদাহরণস্বরূপ তেজগাঁওতে ২০টি, মিরপুরে ৩৫টি উত্তরায় ২০টি গুলশানে ৬টি, ওয়ারীতে ছয়, মতিঝিলে ১১, রমনায় আট এবং লালবাগে চারটি গ্রুপ অধিক মাত্রায় সক্রিয় রয়েছে।
রাজধানীর বাইরে সাভারে প্রায় ১৫টি, টঙ্গীতে ৩০টি এবং নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোকে অপরাধের অভয়ারণ্য বানিয়ে রেখেছে।
ফলে ঢাকায় প্রতি মাসে ১৫-২০টি খুন হচ্ছে দেশে গত ২০ বছরে এ ধরনের কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জনই খুন হয়েছে শেষ দুই বছরে, যুগান্তরের তথ্যানুযায়ী সাভারে ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা, বরগুনায় নয়ন বন্ডের দ্বারা রিফাত খুন, বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড আর সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রনেতাদের দ্বারা স্বামীকে আটকে গৃহবধূকে গণধর্ষণ ইত্যাদি সবই কিশোর গ্যাংয়ের বিষফল।
বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিদিনই দেশজুড়ে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং, ধর্ষণ এবং খুন-খারাবি ইত্যাদিসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এদের বিবেকবর্জিত অত্যাচার, অযাচিত, মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতনে সমাজ বিষিয়ে উঠেছে। মানুষ অস্বস্তিকর অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। সমাজের নিরীহ অংশ বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে কোনো ধরনের সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্কই বেশি। তারা তাদের সহায়-সম্পদ ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়, মুখ বুজে সহ্য করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো, কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করে অথবা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের গ্যাংয়ের দলে ভিড়িয়ে ফেলে। এ ছাড়া এসব গ্যাংয়ের উৎপাতে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি কথা কাটাকাটি ও বচসা তো সর্বদা লেগেই আছে।
প্রশাসনের সর্বস্তরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং সচেতনতা বিশেষ করে ডিবি প্রধান হারুন সাহেবের এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও প্রশংসনীয় উদ্যোগের ফলে অনেকটা কমেছে এদের উশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড।
এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে তরুণদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও প্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকায় হিরোইজম বা সব কাজে অযথা বাহাদুরি, কাঁচা টাকা-পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিকচর্চার নামে সস্তা ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত এসব গ্যাং এবং তাদের সদস্যসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে ডিজে নৃত্য, নদীপথে ট্রলারযোগে লাউড স্পিকার বাজিয়ে কিশোর-কিশোরীর উদ্যাম নাচশৈলী প্রদর্শন, টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে এবং নিজেকে গ্যাং স্টার ভেবে যা খুশি তাই করছে।
ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। উঠতি বয়সের, স্কুল-কলেজগামী কিশোরদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ওই দিকেই ঝুঁকছে। ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুড়ঙ্গের অন্যপ্রান্তে জমা হচ্ছে নিকষকালো অন্ধকার। যারা এই জাতিকে আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে তারা যদি এই আগ্রাসী কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির চর্চা করে বেড়ে ওঠে তবে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। সুতরাং আজকের কিশোর গ্যাং কালচার দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহুরে জীবনের পাড়ায় পাড়ায় কিশোর-তরুণরা প্রথমে ছোট ছোট গ্রুপ করে ‘স্টার বন্ড’, ‘সাইজ কইরা দে’, ‘আমিই বস’ ইত্যাদি উদ্ভট অথচ রোমাঞ্চকর গ্রুপের নামে আড্ডাবাজি শুরু করে। ধীরে ধীরে শুরু হয় ছোট ছোট দলগত অপরাধকর্ম ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার বা দলগত সেরা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। অন্য দল বা অন্য এলাকার কিশোরদের ওপর প্রভাবশালী হয়ে ওঠার এক রোমাঞ্চকর স্বাদ তারা পেয়ে যায় কাউকে মারধর করে বা অপমান করে।
ভিকটিমরাও তখন প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে ঘটে যায় খুনের ঘটনা। জড়িত হয়ে পড়ে স্থানীয় নেতারাও। তারা ‘বড় ভাই’ হিসেবে আগলে রাখেন গ্যাংগুলোকে। বিনিময়ে নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন এসব গ্যাংকে। গ্যাংয়ের সদস্যরাও ‘বড় ভাই’দের শেল্টারে থেকে নির্বিঘ্নে করে যায় নানা অপরাধ। ‘বড় ভাই’য়েরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্পর্শ থেকে আগলে রাখে গ্যাংয়ের সদস্যদের। এভাবে একটি কিশোর গ্যাং জন্ম নিয়ে দাপটের সঙ্গে এলাকায় বিস্তার করে ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’। এদের একটা অংশ বিকট শব্দে হর্ন (মোটরসাইকেল) বাজিয়ে স্টান্টবাজি করার নামে জনমনে আতঙ্ক ও পরিবেশের বিরূপ প্রভাব ফেলে নিজেদের মধ্যে আনন্দ উল্লাস ভাগ করে নিয়ে পরিবারের অপরাপর সদস্যকে অপমানিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
সমাজ চিন্তকরা মোটা দাগে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই কিশোর গ্যাং নামক সামাজিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে গণ্য করছেন। কালের আবর্তনে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় দৃশ্যমান। এক সময় আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চর্চার ঐতিহ্য ছিল। সমাজে ‘মুরব্বি’ সংস্কৃতির চর্চা ছিল। পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। দূর থেকেই সালাম দিত, হাতে সিগারেট থাকলে ফেলে দিত। অন্যায় করতে দেখলে বড়রাও ছোটদের শাসন করত। ছোটরা বেয়াদবি করলে বড়রা এগিয়ে এসে বিচার-সালিশ বসাত। সেই ঐতিহ্য আজ ভেঙে পড়ছে। মুরব্বিরা ভীত, কিশোর-তরুণরা বেপরোয়া। সামাজিক সেই বন্ধন ও শৃঙ্খলা খসে পড়েছে। বাবা-মায়েরা পেশা ও ব্যবসায় টাকা রোজগারে ব্যস্ত। সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি দেখার সময় তাদের নেই? তা ছাড়া ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং পরিবারে ভাঙনের কারণে সন্তানরা সহজেই বিপথগামী হয়ে পড়ছে। একশ্রেণির নারীবাদীর উসকানিতে বিভ্রান্ত হয়ে ধর্মীয় অনুশাসনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অনেকেই সামাজিক শৃঙ্খলা ও বন্ধনকে পদদলিত করে ফেলছে। ফলে ঘরে ঘরে আজ অশান্তির আগুন জ্বলছে। বস্তি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সব ঘরের ছেলেমেয়েরাই এভাবে বিপথগামী হয়ে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। এদের প্রতিরোধের জন্য পরিবারের দায়িত্ব অনেক। সমাজেরও কিছু দায় রয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খেলার মাঠ, পুকুর, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা বা পুকুর-নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করার সুযোগ নিঃশেষ হয়ে গিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে গিয়েই গ্যাং সৃষ্টি করেছে। আগে অঞ্চলভিত্তিক, পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো, যাতে সবার মধ্যে সৌহার্দ্যর বন্ধন অটুট থাকে এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হতো। সেই সুযোগ হাল আমলে একেবারেই ফুরিয়ে গেছে। আগে যেখানে সুস্থ বিনোদন ও সাংস্কৃতিকচর্চা হতো এখন সেখানে অপসংস্কৃতি জায়গা দখল করে নিয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির নামে আমরা নগ্নতা আর বেহায়াপনাকে আধুনিকতা হিসেবে সামনে নিয়ে আসছি এর দরুন কিশোর-তরুণরা অশ্লীলতাকে আর অপরাধ হিসেবে দেখছে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এই কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে কম দায়ী নয়। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরদের যেকোনো মূল্যে ‘জিপিএ-৫’ পাওয়ার দিকে পরিচালিত করে। তাত্ত্বিক এই শিক্ষাব্যবস্থায় না আছে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার দিকনির্দেশনা, না আছে কোনো মূল্যবোধের আদর্শে নিজেকে তৈরি করার বাস্তবমুখী গাইডলাইন। ফলে যারা মেধাবী তারা শুধু টাকা উপার্জনের রোবোটিক যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে আর বাকিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে।
শিশু-কিশোরদের পথভ্রষ্ট হওয়ার বড় একটি কারণ হলো, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। এক সময় প্রতিটি এলাকায় মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনদের একটি বিশেষ অবস্থান ছিল। তাদের ছোট-বড় সবাই মানত। শিশু-কিশোররা তাদের কথা অবশ্য পালনীয় মনে করত। তারাও এলাকার কিশোর-তরুণদের স্নেহ-আদর এবং শাসন করতেন। সমাজে সেই ধর্মীয় সংস্কৃতির অবনতি ঘটেছে। একটি মহল প্রমাণ করতে মুখিয়ে থাকে, দেশ ও জাতির সব অনিষ্টের মূলেই ধর্ম এবং ‘হুজুর’রা। একশ্রেণির মিডিয়া অত্যন্ত সুকৌশলে এসব অপপ্রচারণাও চালিয়ে থাকে। ফলে সমাজের শিক্ষিতদের একটি অংশ মনে করে, নিখুঁতভাবে ধর্ম পালন করা গোঁড়ামি বা উগ্রবাদ চর্চার নামান্তর। বুঝে বা না বুঝে তারা ইসলাম ধর্মকে এবং এর আলেম-ওলামাকে অবজ্ঞা করে থাকেন। এর ফলে
আজ কিশোর-তরুণ-যুবকরা ধর্মীয় মূল্যবোধের শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে বেপরোয়া জীবনযাপন করতেই গর্ববোধ করতে চাচ্ছে। তা ছাড়া বেশ কিছু দিন ধরে কিছু আলেম-ওলামার ইসলামের ঐতিহ্যবিরোধী অতিমাত্রায় রাজনৈতিক বা মারমুখী অবস্থানের কারণে তারা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং সাধারণভাবে ইসলামিস্টদের সম্মানের হানি ঘটেছে। ফলে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী ওয়াজ মাহফিলে তরুণ-যুবারা মঞ্চে উঠে জনসমক্ষে মাহফিল ভণ্ডুল এবং আলেম-ওলামাদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করার সাহস পাচ্ছে। এসব কারণে সমাজের ওপর ধর্মীয় গুরুদের যে ঐতিহ্যগত সুশৃঙ্খল প্রভাব ছিল তা ঢিলে হয়ে পড়েছে। এর ভুল বার্তা যাচ্ছে কিশোর-তরুণদের কাছে। ঘরে-বাইরে কারও আদেশ-উপদেশে তারা কর্ণপাত না করে বরং উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির চর্চার পেছনে সবচেয়ে প্রভাবশালী যে কারণ সেটি হলো- রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর মতে, প্রধানত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘কিশোরদের রাজনীতিতে ঢোকানো হচ্ছে। একটা এলাকায় যে রাজনৈতিক কোন্দলগুলো রয়েছে, সে কোন্দলগুলোকে ধরে রাখা, প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে প্রায় প্রত্যেক এলাকাতেই সরকারের উন্নতিতে বাধাদানকারী একটি চক্র ও রাজনীতিবিদেরই একটি গ্রুপ মনে করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিশোরদের দিয়ে গ্রুপ তৈরি করলে কম খরচে গ্রুপটিকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়, জানা যায়, বিরোধী দল এবং এর ছাত্র ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতা এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডের সাবেক ও কতিপয় কাউন্সিলররা মহানগরের নিজ নিজ এলাকার গোপনে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, এভাবে যেসব ‘বড় ভাইরা’ গ্যাং পরিচালনা করেন তারাই হয়ে ওঠেন কিশোরদের রোল মডেল। ফলে এই কিশোর-তরুণরা ওই সমস্ত ‘বড় ভাইদের’ মতো করে নিজেদের গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। অন্যদিকে, বিদ্যমান আইনও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে। ১৯২২ সালের বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট থেকে ১৯৭৪ সালের শিশুআইন এবং সর্বশেষ প্রণীত শিশুআইন ২০১৩ করা হয়েছে শিশুদের জন্য; কিন্তু এই আইনের ফাঁকফোকরে কিশোররা ‘শিশু’তে সংজ্ঞায়িত হওয়ায় কিশোর গ্যাং দমনে এটি একটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই নীতি-নির্ধারকরা এই আইনটি নিয়ে নতুন করে দ্রুত ভাবতে হবে। কিশোর অপরাধ নিয়ে এখানে ১৯৬০ সালে পুলিশের জন্য প্রথম গবেষণা হয়েছিল। তারপর এর কোনো ফসল ঘরে উঠেছে কি না তা বোধগম্য। এ যাবৎ মোট বেশ কিছু গবেষণার সন্ধান করে পাওয়া যায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দরকার আলাদা কিশোর অপরাধ আইন। আর কিশোরদের যেকোনো মূল্যেই রাজনীতির বলয়ের বাইরে নিয়ে আসতে পারলে এসব কিশোর গ্যাংয়ের অভ্যন্তরীণ শক্তি লোপ পেয়ে এই অপসংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা অবশ্যই ফিরে আসবে। আর দেশ এবং জাতি একটি ভয়াবহ আসন্ন মহাদুর্যোগ থেকে নিস্তার পাবে ইনশাআল্লাহ।
কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে কি কি অপরাধ লক্ষ্য করা যায় ও কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে আমাদের করণীয়
মনিরুল ইসলাম রাজিব: সমাজ ব্যবস্থার দ্রুত শিল্পায়ন ও নগারায়ন রুপান্তরের ফসল হলো কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধ। সত্তর দশক থেকে বিশ্বব্যাপী গ্যাং কালচার প্রবেশ করে। অনেক ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এর নিয়ন্ত্রক হয় সমাজের কিছু বড় ভাই, তবে বড় ভাই ছাড়াও পরিবার কাঠামোর পরিবর্তন শহর ও বস্তির পরিবেশ, সমাজজীবনে বিরাজ মান নৈরাজ্য ও হতাশা, মাদক, অনলাইন গেমস,টিকটক ও লাইকির মতো অপসংস্কৃতি কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে।
কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে কিছু অপরাধ লক্ষ্য করা যায়...
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস না করা,সহপাঠীদের সাথে ঝগড়াঝাটি করা, পরীক্ষায় নকল করা,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ।
১. মাদক গ্রহণ করা।
২. বিনা টিকিটে বাস, ট্রেনে ভ্রমণ করা।
৩. পর্ণ সিনেমা দেখা।
৪. রাস্তা ঘাটে মারপিট, চুরি ছিনতাই করা।
৫. পিতা মাতার দাম্পত্যকলহ লেগে থাকা।
৬. পিতা মাতার পুর্নবিবাহ
৭. পিতা মাতার সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা
৮. অতিরিক্ত শাসন করা
৯. খারাপ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করা।
১০. সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব।
১১. টিকটক,লাইকি, অনলাইন গেমসের মতো অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ।
১২. বিলাসী জীবন যাপনের মনোভাব।
১৩. অল্প বয়সে নিজেকে সুপার হিরো বা নিজের চিন্তা ও কাজকে সঠিক ভাবা।
এজন্যই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ' তের চৌদ্দ বছরের মতো এমন বালাই আর নেই'
এই বয়সে ছেলেমেয়েদের অদম্য সাহসীকতাই তাকে কিশোর অপরাধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিশোর অপরাধ দেশের সার্বিক কল্যাণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
কিশোর অপরাধ কমানোর জন্য আমাদের করণীয় :
১. প্রথমে পিতা মাতাকে তার সন্তানের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে তার সন্তান কার সাথে মেলামিশা করে, ঠিকমতো বিদ্যালয়ে যাচ্ছে কিনা, পড়াশোনা করছে কিনা, সন্ধ্যার আগে বাসায় আসছে কিনা,স্কুলের পড়া নিয়মিত করছে কিনা এবং সন্তান কে টাকা দিতে হবে খুব হিসাব করে, প্রয়োজন ছাড়া টাকা পয়সা একদম দেওয়া চলবে না।
২. সন্তানের সামনে পিতা মাতা কোন ঝগড়াঝাটি করতে পারবে না।
৩. শিশু কিশোরদের অপরাধী হিসাবে না দেখে তাদের দৃষ্টি ভংগী বদলাতে হবে।
৪. টিকটক, লাইকি, অনলাইন গেমস এগুলো বন্ধ করতে হবে,
৫. ১৮ বছরের নিচে এন্ডড্রোয়েট মোবাইল চালাতে পারবে না।
৬. রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন গুলো পরিচালিত হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং তাদের আন্দোলন, দাবি প্রতিবাদ সব কিছুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠাবে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৭. ১৮ বছরের নিচে কোন কিশোর কিশোরীকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশীয় সাংস্কৃতিক চর্চায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।
৯. খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।
১০. সন্ধ্যার পর কোন আড্ডা দেওয়া যাবে না, সেই দিকে নজর রাখতে হবে।
১১. এলাকার বড় ভাই নামক ব্যক্তি যে কিনা কিশোরদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. অপরাধ বড় আকার ধারণ করার আগেই অপরাধী কে গ্রেফতার করতে হবে।
১৩. সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিকতা বোধের শিক্ষা দিতে হবে।
১৪. আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কে সঠিক ভাবে গ্যাং সম্পর্কে ডাটা সংগ্রহ করে কিশোরদের মুল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য কাউন্সিলিং করতে হবে।
আজকের কিশোর আগামীতে দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তাই এদের প্রতি সহনশীল হতে হবে। তাহলেই কিশোর গ্যাং মুক্ত সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারবে।
আমাদের দেশের কিশোররা সত্যিকার অর্থে সোনার ছেলে হিসাবে তৈরি হয়ে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে।
পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই আজকের কিশোর আগামীর ভবিষ্যৎ, এদের কে সঠিক পথ দেখানো আপনার আমার নৈতিক দায়িত্ব।
শুধু শাস্তির ব্যবস্থা করলে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ হবে না। এর জন্য একটি বিকল্প সামাজিক সুস্থ পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন। যে পরিবেশে বিনোদনের উপকরণ হিসেবে খেলাধুলা,বই পড়া, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সুস্থ বিনোদনের আয়োজন থাকবে।
পাশাপাশি থাকতে হবে কিশোরদের মুক্ত ভাবনা নিঃসংকোচে উপস্থাপন করতে পারার ব্যবস্থা। এতে তারা নতুন নতুন ভাবনার সঙ্গে মিলিত হয়ে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা করবে। এতে কিশোররা সমাজে উচ্ছৃঙ্খতা, ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধের দিকে অগ্রসর হবে না। তারা তখন একটি সুশৃঙ্খল পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা কি হওয়া উচিত বুঝতে শিখবে। সমাজের ও দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য কি হওয়া উচিত সে বিষয়েও তারা বোধগম্য হবে। সুন্দর মানুষ, বিকশিত মানুষ হওয়ার যে চর্চা, সে চর্চাকে ব্যক্তিগত জীবনে ক্রিয়া করবে- এই প্রত্যাশা করা যায়।
তাই শুধু কঠোর শাস্তি, প্রতিরোধ, ভয় কিংবা মোটিভেশনাল ট্রিটমেন্টে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি সুস্থ সমাজ, একটি সাংস্কৃতিক জীবনদর্শন, সৃজনশীলতা ও সুস্থ বিনোদন কিশোরদের মাঝে উপস্থাপন করা ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজে কিশোর গ্যাং হিসেবে কিশোরদের পরিচয় নয়। সমাজে একজন দায়িত্ববান, সৃজনশীল, চমৎকার প্রতিভাবান মানুষ হিসেবে জীবন গঠন করবে আজকের কিশোরা।
বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা যাচ্ছে না। দুর্দমনীয় হয়ে উঠা এসব গ্যাং নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিশোরদের বয়স বিবেচনয়ায় আইনের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে ছেলে-মেয়েদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িয়ে রয়েছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ফলে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করা হলেও সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংশোধনাগারে পাঠানো হলেও কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে পুনরায় তারা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি যখন এসএসসি পাস করেছি, তখন আমার বয়স ছিল ১৫ বছর। এখন যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে তারা ১৮ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আমাদের মনে হয়, ১৮ বছরের এ সময়সীমা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।’ তার এ কথা থেকে বোঝা যায়, এখন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি এবং কম বয়সে পড়াশোনা শুরু করার ফলে শিশু-কিশোররা ১৮ বছরের আগেই ম্যাচিউরড হয়ে উঠছে। আক্ষরিক অর্থে তাই দেখা যাচ্ছে। তাদের বোধশক্তি আগের সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এর ফলে, তারা দ্রুত যেমন সবকিছু শিখতে পারছে, তেমনি অনেকে অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠা এবং তাতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের জন্য কিশোর গ্যাং ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকসেবন ও কেনাবেচা এবং ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় গ্যাং তৈরি করে এ ধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৪ জেলায় গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। গোয়েন্দা সংস্থা রাজধানীতে ৬০টির মতো কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে সক্রিয় রয়েছে ৩৪টি। এসব গ্যাংয়ের প্রতিটির সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ১৫-এর মধ্যে। তারা নিজ নিজ এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে এদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করলেও তাতে খুব একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদও তা স্বীকার করেছেন। আইনী সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলেও তিনি জানিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, অপরিণত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের গ্যাং ভয়ানক হয়ে উঠলেও তা দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ও কিভাবে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে? এ নিয়ে সমাজবিদরা বেশ কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেছেন। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষার অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক শাসন-বারণের অভাব এবং অভিভাবকদের উদাসীনতা ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়াকে মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি এসব গ্যাং গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতাও রয়েছে। নেপথ্যে থেকে কিশোরদের ব্যবহার করে তাদের অপকর্ম হাসিল করছে। কিশোর গ্যাং তাদের কাছে নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোররা সামাজিক ও পারিবারিক শাসন-বারণ এড়িয়ে পৃষ্ঠপোষকদের প্রশ্রয়ে দুর্বিনীত হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অর্থলোভ ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা এবং হিরোইজম বিশেষভাবে কাজ করছে। আইনের তোয়াক্কা না করে যেকোনো অপরাধ করতে তারা দ্বিধাবোধ করছে না। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। এতে খুন-খারাবির মতো ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা ঘটছে। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতদের পরিবারগুলোও সন্তানদের সঠিকভাবে খেয়াল রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, এ ব্যাপারে বেখেয়াল হয়ে রয়েছে। সমাজের অভিভাবক শ্রেণীও দায়িত্ব পালন না করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এখন ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। যে কিশোর-তরুণ দেশের ভবিষ্যত, দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা উৎকণ্ঠার বিষয়। ভবিষ্যত প্রজন্মই যদি উৎচ্ছন্যে কিংবা গোল্লায় যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু থাকে না। বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে এক-দুজনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যথেষ্ট। এ বিবেচনায়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত অসংখ্য বিপদগামী কিশোরের উৎপাত সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও ত্রাস সৃষ্টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত ও নির্মূল করা না যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য গ্রেফতার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করে ঠিকই, তবে তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। যেহেতু কিশোরদের অপরাধের ক্ষেত্রে সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তাই এক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক কর্মকান্ড শুরু করতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিভাবক শ্রেণীর সাথে সমন্বয় করে কিভাবে কিশোরদের সুপথে পরিচালিত করা যায়, এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত বৈঠক করতে হবে। যে কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত, তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ সন্তানের চলাফেরা ও আচার-আচরণের পরিবর্তনের দিকে তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশু-কিশোরদের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ সুরক্ষা এবং ধর্মীয় অনুশাসণের ক্ষেত্রে দেশের আলেম-ওলামারা বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। তবে তাদেরকে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নানা মহলের বাধা ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। এসব বাধা-বিপত্তি দূর করে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে।
কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন
দেশজুড়ে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে উঠতি কিশোরদের গ্যাং কালচার। এই কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের মধ্যকার সিনিয়র-জুনিয়রদের দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা, মাদক, নারী নির্যাতন। এমনকি খুন-খারাবির প্রবণতাও রয়েছে এদের মধ্যে। টিকটক লাইকিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে গিয়ে এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। আর কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই সমাজে এই গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এদের কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাং আসলে কারা? কিশোর গ্যাং হচ্ছে ১৮ বছরের নিচে যেসব কিশোর দলবদ্ধভাবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা চালায়। দেখা যায়, ১৫ থেকে ১৬ বছরের কিশোররাই কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে।
কিশোর গ্যাংদের কাজ হচ্ছে মানুষকে উত্ত্যক্ত করা, মেয়েদের টিজ করা, বকাবকি করা, হুমকি দেওয়া, স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের উদ্দেশে বাজে কমেন্ট করা, ভয়ভীতি দেখানো, সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এই বখাটে কিশোররা পড়ালেখা না করে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তারা সাধারণত রাতে দলবদ্ধভাবে নেশাদ্রব্য পান করে। এতে তারা উগ্র হয়ে ওঠে। আমাদের করণীয় হলো, সামাজিক সচেতনতা তৈরি করে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা। আর প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় কিশোর অপরাধীদের খবর। এদের সুপথে আনতে হলে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন।
কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারিক সচেতনতায় গুরুত্বারোপ
ঘরে ঘরে গিয়ে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরিবারকে সচেতন হওয়া জরুরি- বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান ।
সকালে রাজধানীর এফডিসিতে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায়, প্রধান অতিথির বক্তব্য এসব কথা বলেন তিনি। এসময় ডিএমপি কমিশনার বলেন, কিশোর গ্যাং নির্মূলে আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ আছে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। কিশোর গ্যাংদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করে তালিকা করা হয়েছে।
কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরূপে দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং এখনো বেড়েই চলেছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার লক্ষ্যে এখনই এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে এটি খুব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বৈশিষ্ট্য
এক্ষেত্রে কিশোরদের বয়সটা জানা বেশি জরুরি। কারা কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিচ্ছে বা কত বছর বয়সে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এদের বয়সসীমা ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। কী করে বুঝবেন যে এরা কিশোর গ্যাংরে সঙ্গে যুক্ত আছে? সাধারণত প্রতিটি গ্যাংয়ের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এমন একটি নির্দিষ্ট নাম ও লোগো থাকে। গ্যাং সদস্যদের মধ্যে সেই নাম ও লোগো শরীরে ট্যাটু করার অথবা দেয়ালে লিখনের প্রবণতা রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এবং সর্বদা আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাংয়ের প্রচার-প্রচারণার নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা গ্যাং সংগঠন নিয়ে গর্ববোধ করে এবং গ্যাং সদস্য হিসাবে পরিচিত হয়ে তৃপ্তি অনুভব করে। ক্ষেত্রবিশেষে গ্যাংয়ে একই রকমের জামাকাপড় পরার স্টাইল দেখা যায় এবং কেউ কেউ অথবা সবাই জুয়েলারি ও অলংকার পরিধান করে থাকে। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা অস্ত্র যেমন- ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে।
কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার কারণ
সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। একই কমিউনিটির ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে, তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যকে বঞ্চিতদের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা অনুভব করে। আবার কমিউনিটিতে যখন অস্ত্র ও বিশেষ করে মাদকের দৌরাত্ম্য থাকে তখন গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে এবং বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে অথবা ওই গ্যাংয়ের বিদ্রোহী, দলছুট বা বহিষ্কৃত সদস্যরা আরেকটি গ্যাং তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ কমিউনিটিতে যখন গ্যাংয়ে যোগদান করার অভ্যাস অথবা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন একজন অপরকে বা সিনিয়রকে দেখে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। কখনো ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে অনুকরণপ্রবণশীল কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। তখন সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায় কিশোররা। তাই পরিবারের করণীয়টা এখানে বড় হয়ে দাঁড়ায়।
পারিবারিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই এ সমস্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক/নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলেও কিশোররা এ পথে আসতে উৎসাহিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে অথবা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মাঝে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। যেমন- দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে গ্যাং গড়ে তোলার প্রবণতা থাকে। ক্রমাগত শিক্ষকের বঞ্চনা, খারাপ ফলাফল, সহপাঠী দ্বারা বিদ্রুপের শিকার থেকে হতাশা তৈরি হতে পারে। হতাশা থেকে পরে গ্যাংয়ে যোগদানের প্রবণতা তৈরি হতে পারে। স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগ্রত হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা ইত্যাদি তৈরি হয়, যা থেকে গ্যাংয়ের উদ্ভব হতে পারে। বন্ধু-বান্ধবের যদি অপরাধপ্রবণতা থাকে বা তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে, মাদক সেবনের প্রবণতা থাকে বা মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এভাবে জড়িত হওয়ার কারণের মধ্যে আরও রয়েছে- ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা, দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব, হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা, অনুকরণপ্রবণতা, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি বা যৌন আসক্তি হওয়ার ক্ষেত্র ও সুযোগ তৈরি হওয়া।
দেশে কিশোর গ্যাংয়ের বর্তমান অবস্থা
মূলত ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার নির্মমতা জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়। ৬ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের উপর আদনান কবিরকে (১৪) সংঘবদ্ধ গ্যাং মারাত্মকভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। তখন তিনটি গ্যাংয়ের (ডিসকো বয়েস, বিগবস্ ও নাইনস্টার) মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আদনানকে ধারালো অস্ত্র ও হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করা হয়। ফলে আদনানের মৃত্যু হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে র্যাব-১, উত্তরা, ঢাকার একটি আভিযানিক দল উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়ক এলাকায় একটি অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর আদনান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৩ নম্বর আসামি এবং ডিসকো বয়েস গ্যাং গ্রুপের দলনেতাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরে মূল আসামি তালাচাবি রাজুকেও র্যাব গ্রেফতার করেছিল। আমরা জানি, র্যাবের হাতে এ সময় একের পর পর গ্যাং ধরা পড়েছে এবং তাদের ধরতে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করেছিল র্যাব। ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি র্যাব ২৭২ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। শুধু হত্যাকাণ্ডের পৃথক চারটি ঘটনায় মোট ২০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর র্যাব ২০১৯ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সেবন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের সংশোধনাগারে প্রেরণ করেছিল, যা সে সময় দেশে আলোচনার শীর্ষে ছিল।
পুলিশ ও র্যাব সূত্র বলছে, রাজধানীতে এখন অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজার। রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বৃহত্তর মিরপুর, পুরান ঢাকার লালবাগ ও হাজারীবাগ এলাকায়ই মূলত কিশোর গ্যাং ছড়ানো-ছিটানো (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮২১টি মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা ১ হাজার ১৯১। সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় ‘অপু ভাই’ নামে খ্যাত টিকটক ভিডিও নির্মাতা একটি রাস্তা অবরোধ করে ৭০-৮০ জন মিলে টিকটক ভিডিও তৈরি করছিল। সে সময় রবিন নামে একজন প্রকৌশলী গাড়ি নিয়ে রাস্তা পার হতে গেলে অপুসহ তার দল মিলে মারধর করে ওই ব্যক্তির মাথা ফাটিয়ে দেয়।
একটি কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়েছিলেন এমন একটি ছেলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল র্যাবে থাকাকালীন। সাজিদ হক (ছদ্মনাম) কোনো এক সময় কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উঠতি বয়সের পাড়ার ছেলেদের দলবলের সঙ্গে যুক্ত হয় পাড়ার একটি ছেলে। তার সিগারেট খাওয়া দেখে প্রথমে সাজিদের একটু খারাপ লাগলেও অনেক দিন দেখার পর নিজেও একদিন খাওয়া শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় সাজিদের সিগারেট খাওয়া। ক্লাস নাইনে পড়ে। টাকা-পয়সা নেই। কিন্তু সিগারেটের নেশা তাকে ধরে ফেলেছে। বাসা থেকেও বাবা-মা টাকা দেয় না। কিন্তু সিগারেট তার খেতেই হবে। একদিন-দুদিন পর সেই ছেলেটার সঙ্গে মিশে নানারকম অপকর্মে লিপ্ত হতে থাকে সাজিদ। চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে সবকিছুই করে পরিবারের অজান্তে। আস্তে আস্তে ওদের গ্যাংটা বড় হতে থাকে। বড়লোকের ছেলেরা এসে জমা হতে থাকে। একটা আড্ডার জায়গা হয়। পরে একসময় ছেলেটার বাবা মারা যায়। এরপর সংসারের নানা বিষয়ের চিন্তা থেকে ফিরে আসে ছেলেটি। এখন সে খুব ভালো একটা চাকরি করে সংসারে মা-বোনকে দেখে।
সমাধান কীভাবে
১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী গ্যাং কালচারে ব্যাপক সহিংসতা প্রবেশ করে। অনেক ক্ষেত্রেই কিশোর গ্যাংদের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় সমাজের কিছু বড়ভাইয়ের ছায়া থাকে। তবে দলগতভাবে ছায়া প্রদানের চেয়ে অনেকেই মনে করেন ব্যক্তি পর্যায়ে সেল্টার বা ছায়া প্রদানই বেশি হয়ে থাকে। তবে যারাই নিয়ন্ত্রক/পৃষ্ঠপোষক হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। সবারই উচিত প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে উঠতি বয়সে নজরে রাখা, তারা কী করছে না করছে সব সময় খোঁজখবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে সময় দেওয়া। কিশোর অপরাধ কমাতে হলে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টাতে হবে। অপরাধী হিসাবে না দেখে শিশু-কিশোরদের কৃতকর্মকে মানসিক স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা জরুরি। দেশের একটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত গবেষণায় দেখা যায়, সেখানে থাকা ৫৭ শতাংশ শিশু-কিশোরের মানসিক সমস্যা রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকের কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডারের জন্য সুচিকিৎসার প্রয়োজন।
আমাদের দেশে পর্যাপ্ত কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নেই। গাজীপুরে দুটি এবং যশোরে একটি শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য। সব মিলিয়ে এ তিনটির ধারণক্ষমতা মাত্র ৬০০ জনের। এ কারণে আটক শিশুদের বড় একটি অংশ কারাগারেই থাকে, উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না তাদের। এতে দেখা যায়, আদালতের নির্দেশে কোনো কিশোরকে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কিছুদিন পর সে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়ার ক্ষেত্রে বাজেটে বড় অংশের অন্তর্ভুক্তিতে মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৫ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, যা পরবর্তী বছরে গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিশোরদের মনন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেধা ও প্রতিভা বিকাশে শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ স্কাউটস, গণিত অলিম্পিয়াড, রোবটিকস্ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন যেমন- সংগীত, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, লেখালেখি, নাটক ইত্যাদিরও প্রায়োগিক অনুশীলন অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন করতে হলে কমিউনিটি লিডারশিপ শক্তিশালী করতে হবে, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে। কমিউনিটিতে সুস্থ বিনোদনও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানকে বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলির শিক্ষা দিতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে এবং একইসঙ্গে সন্তানের আচার-আচরণের ওপর খেয়াল রাখতে হবে যাতে পারিবারিক শিক্ষা সমুন্নত থাকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে- ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে কিনা; স্কুলে মাদক সেবন, র্যাগিং ইত্যাদি হচ্ছে কিনা।
দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কোনো ধরনের অপরাধ বড় রূপ নেওয়ার আগে অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে।
আঠারো শতকের শেষে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের জন্য স্যালফোর্ড ল্যাডস ক্লাব নামে ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিল গ্রোভস্ পরিবার, আজ যার বিশ্বব্যাপী পরিচয় ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নামে। রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল, যিনি স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পরিচিত, তার হাত ধরেই এ ক্লাব সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। এভাবে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিলে এবং উন্নয়নমূলক কাজের দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে বাংলাদেশেও কিশোর গ্যাং নামক দুঃস্বপ্নের আধিপত্য কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য মারাত্মক এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে । কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সমাজ তথা দেশের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, এই গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। উঠতি বয়সের ১৫ থেকে ১৭ বছরের কিশোররা পরিণত হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ে।
পরিসংখ্যান বলছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাধারণ মানুষকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করা, ইভটিজিং বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের উদ্দেশ্যে বাজে মন্তব্য করা, একে অন্যের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হওয়া, ভয়-ভীতি, হুমকি দেওয়া, মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত হওয়া ইত্যাদি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এক বা একাধিক পক্ষের হয়ে বিবাদে জড়িয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটাচ্ছে এসব উঠতি বয়সীরা৷ এক শ্রেণীর সন্ত্রাসীরা এসব কিশোরদের ব্যবহার করে সংঘটিত করছে নানা অপরাধ মূলক কর্মকান্ড৷ এক সময় এসব অপরাধের পাশাপাশি মাদকের ভয়াল নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে কিশোররা। তখন মাদকের অর্থের জোগান দিয়ে নিয়মিত ছিনতাই, চুরি, চাঁদাবাজি থেকে ডাকাতির মতন বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এসব কিশোররা। প্রতিনিয়ত আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে আটকের পাশাপাশি কারাগার গুলোতে বাড়ছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা৷ বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে কিশোর গ্যাংকে নির্মূল কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
এবার কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ, অপরাধ দমন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থানীয় কিশোর ও তাদের অভিভাবকদের নিয়ে ব্যতিক্রমি সভার আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চান্দগাঁও থানা কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং।
শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকেল ৫টায় চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চান্দগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ জাহিদুল কবিরের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাঁচলাইশ জোন) আরিফ হোসেন।
মতবিনিময় সভায় কিশোরদের অপরাধ দমনে করণীয় সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে - সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পারিবারিকভাবে ভাল-মন্দ বিষয়ক শিক্ষা দেওয়া, কিশোরদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা, পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধূলার ব্যাবস্থা করা, কিশোরদের তার মা-বাবার উচিত পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, তাদের সহিত পারিবারিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা, তারা কার সাথে মেলামেশা করে তার খোঁজ খবর নেওয়া, তারা কখন বাসায় ফিরছে, কোথায় কার সাথে ঘোরাফেরা করছে তার খোঁজ খবর নেওয়া। এছাড়া তাদের বিখ্যাত লেখকদের গল্পের বই পড়ায় আগ্রহী করা।
সভায় মূল আলোচকরা বলেন, কিশোররা যেন তাদের পরিবারের ব্যাধিতে পরিণত না হয়ে ঘরের আলো হয়ে ওঠতে পারে তার ব্যাবস্থা করতে হবে। কিশোররা যেন সমাজের বিষ ফোঁড়া না হয়ে আগামীর ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারে সেই উদ্যোগ নিয়ে হবে। তাদের অবহেলা না করে তাদের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা, যত্ন বৃদ্ধি করা।
এ ছাড়াও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের অংশ হিসাবে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পুলিশের কাজে সহযোগিতা, অপরাধবিরোধী সচেতনতা তৈরি, বাল্যবিবাহ রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, মাদক নির্মূল, জঙ্গিবাদ দমন, সন্ত্রাস দমন, মাদকের কুফল, নারী ও শিশু নির্যাতন, যৌতুকনিরোধ, বাল্য বিবাহ, চাঁদাবাজী, ছিনতাই, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার, সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
মতবিনিময় সভায় মোহরা ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী নুরুল আমিন মামুন, চান্দগাঁও থানা কমিউনিটি পুলিশিং সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী,মোহরা ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি এস এম আনোয়ার মীর্জা,কমিউনিটি পুলিশিং বীট নং-৪০ এর সভাপতি আলমগীর, কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি উপদেষ্টা রফিক কোম্পানী সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
যেসব কাজ প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, প্রচলিত আইন ভঙ্গকারী ওই ধরনের কাজ অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হলে সেটিকে কিশোর অপরাধ বলা হয়। কিশোর বয়সের চাহিদা হলো- নিজেকে প্রকাশ করা। আত্মপ্রকাশের চাহিদা তাদের মাঝে কৌতূহলপ্রিয় করে তুলে। কৌতূহলের বশে নতুন কিছু জানতে চায়, শিখতে চায়। এ স্বতঃস্ফূর্ত আকাক্সক্ষাকে যদি মাতা-পিতা, শিক্ষক, অভিভাবক সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন তবে এ ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যত জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে সফল মানুষ হয়। এ ছাড়া কিশোরদের অপরাধী হওয়ার নেপথ্যে আরও কিছু স্বভাবগত কারণ রয়েছে। যেমন- মাতা-পিতার অযতœ-অবহেলা, উদাসীনতা, স্নেহীনতা, সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদানে অমনোযোগিতা, পারিবারিক পরিম-লের ঝগড়া-বিবাদ, দারিদ্র্য, সুষ্ঠু বিনোদনের সঙ্কট, সামাজিক অসাম্য, দুঃখ দুর্দশা, যথাযথ তদারকির ঘাটতি, অবিচার, আশৈশব দুর্ব্যবহার প্রাপ্তি, কুসংস্কার ও কুসঙ্গ, অতি আদর, আর্থিক প্রাচুর্য ও অনিদ্রার মতো বিষয়গুলো কিশোরদের অপরাধী করে তোলে। কিশোর অপরাধী হলো সেই সকল কিশোর-কিশোরী যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজবিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণত ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মা-বাবার সঠিক নজরদারির অভাবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপনের ফলে ছেলেমেয়েরা বখে যাচ্ছে। ফলে ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি এবং অপরাধ করতে করতে পরবর্তীতে তারা বড় অপরাধ করে বসছে। আবার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চলতে চলতে মজার ছলে কিছু একটা করে বসে যা পরবর্তীতে বিরাট আকার ধারণ করে। এই সমস্ত ছোট ছোট অপরাধ যদি শুরুতে সাবধান করা যেত তাহলে অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসত। সামাজিক সমস্যা হিসেবে এবং অপরাধ জগতে কিশোর অপরাধ ক্রমবর্ধমানশীল। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতিতেও ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে সারাদেশে কিশোর গ্যাংদের হাতে ৮ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ঘটনা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা শহরের ১০টি থানায় ৩২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে এবং ৫০০-৫৫০ জন সক্রিয় সদস্য ঢাকা শহরে নানারকম অপরাধ সংঘটিত করছে। তাদের মধ্যে উত্তরায় আদনান হত্যা, দক্ষিণখানে মেহেদী হত্যা এবং শেওড়াপাড়ায় সজিব হত্যা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। চুরি, ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন ও ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচারব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশুনীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এরপর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোন ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতিষ্ঠান শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করে। পরিচালকের (প্রতিষ্ঠান) নেতৃত্বে অতিরিক্ত পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক সদর দফতর পর্যায়ে এবং মাঠপর্যায়ে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জেলা পর্যায়ের ৩ জন উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক মাঠপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং মাঠপর্যায় ও সদর দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক উক্ত কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের গাজীপুরের টঙ্গীতে বালকদের জন্য ৩০০ আসনের জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, কোনাবাড়ীতে বালিকাদের জন্য ১৫০ আসনের জাতীয় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র এবং যশোরের পুলেরহাটে বালকদের জন্য আরও ১৫০ আসনের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। কিশোর অপরাধ দমনে সরকার বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। অপরাধের ধরন বিবেচনায় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সেল গঠন করা হয়েছে যেন অতি দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপরাধের শাস্তি এবং প্রতিকারে কী করণীয় তা প্রচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের গণযোগাযোগ অধিদফতর ভ্রাম্যমাণ যানবাহনে নৈতিকতার শিক্ষা প্রচার করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল কলেজের সামনে বিভিন্ন বিলবোর্ডের মাধ্যমেও তা প্রচার করা যেতে পারে। আমাদের বর্তমান সমাজে পাঠাগার, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রম কমে গেছে এবং তাকে দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন ও আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকা- বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কারণে কিশোর অপরাধ রোধ করার দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ স্কুলব্যবস্থার ওপর পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার যা বিদ্যালয়গুলোকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই ওই গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর কিছু ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মনমানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই সন্তানের অবসর সময় কিভাবে কাটছে তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবেই কিশোর অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে। লেখক : সাংবাদিক
২০১৭ সালে আদনান হত্যার মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর থেকে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টেনে ধরা তো দূরের কথা, গ্যাংয়ের সংখ্যা ও অপরাধ সারা দেশে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি গ্যাং কালচার সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তৃত হয়। সেজন্য কিশোর গ্যাং আতঙ্কে ভুগছে পুরো সমাজ।
কিশোর গ্যাংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি
পুলিশের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, সারা দেশে ১৭৩টি ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। শুধু ঢাকায় রয়েছে ৭৫-৮০টি কিশোর গ্যাং। আরেকটি অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে ৫ থেকে ১৫ জন সদস্যের অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বড় বড় শহর থেকে মফস্বল শহরগুলোতেও ছড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন নামে এদের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে, যেমনÑ ‘বিগবস’, ‘এফ টেন’, ‘গাংচিল’, ‘ম্যাক্স পলু’ ইত্যাদি। এসব গ্রুপের সদস্যরা দলবেঁধে চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, লুট, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এমনকি হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। পুলিশের হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে শুধু রাজধানী ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। যারা হত্যার শিকার তাদের মধ্যে অনেকেই স্কুল বা কলেজ শিক্ষার্থী। এমন পরস্থিতিতে পুরো সমাজ দিশেহারা এই ভেবে যে, এদের দৌরাত্ম্য আরও বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
কিশোর গ্যাং কেন এত বেপরোয়া
অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে অপরাধ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ দমনের লক্ষ্যে পুলিশি ও আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। ডিএমপি গত দুই মাসে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের কমপক্ষে ২০০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলে। তারপরও তাদের সংখ্যা কমছে না। নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক মুখপাত্র বলেন, ‘পুলিশ প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। বছরে ৪/৫শ’ আটক হচ্ছে। মামলা হচ্ছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না মূলত কথিত কিছু বড় ভাই ও কিছু পলিটিক্যাল নেতার কারণে।’
আসলে কিশোর গ্যাংয়ের নাটাই যদি কিশোরদের হাতে থাকত তাহলে তারা এতটা ভয়ঙ্কর ও বেপরোয়া হতে পারত না। কথিত ‘বড় ভাই’ বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারাই যখন এর হর্তাকর্তা, তখন মামলা ও তদন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে। দন্ত চিকিৎসক হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং নেতার ‘টর্চার সেল’ আছে। নিশান নামের এই গ্যাং যে অপরাধই করুক, কেউ বাধা দিলে বা সমালোচনা করলে তাদের এই ‘টর্চার সেলে’ ধরে আনা হয় এবং নির্মম নিপীড়ন করা হয়। এই গ্রুপের মূল কাজ চাঁদাবাজি। এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বিধায় শত শত ‘নিশান’ গ্রুপের জন্ম হচ্ছে।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জসমূহ
অপ্রতুল কিশোর সংশোধনাগার : সাধারণত কিশোর অপরাধকে সংশোধনযোগ্য অপরাধ মনে করা হয়। সে চিন্তা থেকে কিশোরদের জন্য কিশোর সংশোধনাগার রয়েছে। সারা দেশে মাত্র ছয়টি কিশোর সংশোধনাগার রয়েছে; এসবে মাত্র এক হাজার ১০০ কিশোরকে জায়গা দেওয়া যায়। এমন অপ্রতুলতার কারণে অনেক অপরাধীকে সংশোধনাগারে রাখা সম্ভব হয় না। অল্প কিছুদিন রেখেই ছেড়ে দেওয়া হয় বিধায় তারা আবার একই গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। এতে গ্যাং দুর্বল না হয়ে আরও শক্তিশালী হয়।
আইনি জটিলতা : কিশোর হওয়ার কারণে কিশোর গ্যাং তৈরি করা সহজ। কেননা কিশোরদের অপরাধকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধরা হয় না, কারণ এটি ফৌজদারি অপরাধ নয়। অপরাধগুলো ফৌজদারি হলেও ‘কিশোর’ হওয়া তাদের ফৌজদারি আদালতে শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় নেতা বা প্রভাবশালীরা এই সুযোগে কিশোরদের ব্যবহার করে। তারা লক্ষ করেছে, যেহেতু কিশোররা অপরাধ করলেও শাস্তি পাবে না, তাই কিশোর গ্যাং তৈরি করা কম ঝুঁকিপূর্ণ। এমন আইনি জটিলতায় কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা : যে কিশোরের হাতে কলম আর বই থাকার কথা সেই কিশোরের হাতে লাঠি, হকস্টিক, ছুরি, আর পিস্তল কেন থাকবে? স্কুলে তাদের ক্লাস আর অধ্যয়ন নিশ্চিত না হলে বড় অপরাধীরা তাদের ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে যাবে। হচ্ছেও তাই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডায় জমায়েত হয়। স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রায়োগিক পদ্ধতি অত্যন্ত শিথিল বিধায় ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার হার মাত্রাধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপর শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ আগের মতো নেই। কারণ তাদের শাসন করা বারণ। তাছাড়া স্কুলভিত্তিক লেখাপড়া আর পরীক্ষা পাসের সহজ ব্যবস্থা থাকায় লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের উদাসীনতা বেড়ে গেছে। এতে করে কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দেওয়ার সুযোগ বেড়ে গেছে।
সামাজিক পরিস্থিতি : ঝরে পড়া শিক্ষার্থী এবং শিশুশ্রমে জড়িতদের মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হতে দেখা যায়। দুর্বল পারিবারিক বন্ধনও এর অন্যতম কারণ। পারিবারিক বন্ধন দিনে দিনে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। চলমান ভোগ-সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পিতা-মাতার মূল লক্ষ্যই থাকে অধিক উপার্জন। অধিক উপার্জনে অধিক সময় দেওয়ার ফলে সন্তানের যত্ন এবং সন্তানের গতিবিধি আগের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না অনেক পিতা-মাতা। অনেক সচ্ছল পরিবারে সন্তান অতি প্রশ্রয়ে লালিত হয়। অল্প বয়সেই তাদের হাতে স্মার্টফোন চলে আসে। স্মার্টফোনের সুবাদে বিনোদনে আর অসংলগ্ন যোগাযোগে তারা প্রবৃত্ত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে আড্ডায় মেতে ওঠে, নিজেকে হিরো ভাবতে শিখতে আর এলাকায় প্রভাব বিস্তারের নেশায় উন্মত্ত হয়। মুরব্বিদের মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দুর্বল হওয়ায় তাদের বেপরোয়া ‘ক্ষমতা’ প্রদর্শন বাড়তে থাকে।
কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে করণীয়
কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ জরুরি। এজন্য যে দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া অত্যাবশ্যক তা হলোÑ
১. কিশোর গ্যাং দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন চালাতে হবে, যেন কিশোর গ্যাংয়ের নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়।
২. আইসিটির সহায়তায় কিশোর গ্যাংয়ের যত অনলাইন গ্রুপ আছে সব চিহ্নিতপূর্বক বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. ‘কিশোর’ অপরাধ আর ‘কিশোর গ্যাং’ অপরাধকে আইনত আলাদা করে দেখতে হবে। ‘কিশোর গ্যাং’ অপরাধের বিচার কিশোর-আদালতের অন্তর্ভুক্ত না করে কিশোর গ্যাং অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মীমাংসা করতে হবে।
৪. ‘কিশোর গ্যাং’ অপরাধের বিচারের জন্য আইনি সংশোধনী আনতে হবে, যাতে করে ‘বড় ভাই’দের বিচার নিশ্চিত করা যায়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পদক্ষেপে সুদৃঢ় সংস্কার আনতে হবে।
৫. শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মান উন্নয়নে জোর দিতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে, ক্লাস ফাঁকি রোধে কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলা জারি রাখতে হবে।
৬. যারা ক্লাসে অনিয়মিত তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে হবে।
৭. কিশোর সংশোধনাগারের সংখ্যা আরও বহুগুণ বাড়াতে হবে এবং এসবের ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক ও মানসম্মত করতে হবে।
৮. কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডা বা অপরাধের তথ্য গোপনে জানাতে আলাদা কল নম্বর রাস্তার অলিতে-গলিতে সেঁটে দিতে হবে; যেন পুলিশি অভিযানে আড্ডার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
৯. সন্তানদের উপর পিতা-মাতার নজরদারি বাড়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অভিভাবক মিটিং বৃদ্ধি করতে হবে। কিশোর সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। প্রত্যেক পিতা-মাতাকে নিজ সন্তানদের নৈতিকতা শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে।
১০. পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এমনকি নৈতিকতার শিক্ষার উপর ব্যবহারিক নম্বরের ব্যবস্থা রাখতে হবে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়াকে শিশু-কিশোরদের নৈতিকতা বৃদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে হবে।
ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকরা অদৃশ্য কেন?
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
বিভিন্ন গণমাধ্যমসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশবাসী চলমান কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা নিয়ে সম্যক অবগত। দেশের নগরÑশহরসহ তৃণমূল পর্যায়ে এদের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড সমগ্র জনগণের হৃদয়ে শুধু গভীর আতঙ্ক তৈরি করছে না; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পদচারণা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে তা নিয়ে তারা দারুণ যন্ত্রণাদগ্ধ। জনশ্রুতিমতে, প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে অত্যন্ত পরিচিত ‘বড় ভাই’ নামধারী পৃষ্ঠপোষকদের সার্বিক অনুপ্রেরণা-সহযোগিতায় এদের চরম বেপরোয়া হওয়ার বিষয়টি সর্বত্রই প্রকাশ্যে। প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যম-ইলেকট্রনিক সম্প্রচার-সামাজিক যোগাযোগ-অনলাইনভিত্তিক ইউটিউবসহ সব ধরনের প্রচারে এত সব ভয়ানক দৃশ্যপট উপস্থাপিত হচ্ছে; তাতে মনে হয় সমাজের পঙ্গুত্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর তেমন অবশিষ্ট নেই। একদিকে অসৎ-অযোগ্য-অপদার্থ-প্রতারক-ছলচাতুরীতে সিদ্ধহস্ত কথিত মহল পদ-পদায়ন-পদকে ভূষিত হয়ে সমাজকে সমৃদ্ধ করার উদ্ভট ধারণায় উজ্জীবিত; অন্যদিকে অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় ভূমিদস্যু-জলদস্যু-অর্থপাচারকারী আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত নষ্ট চরিত্রের মানুষরূপী নরপশুগুলোর আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা অব্যাহত। কমবয়সী-অপ্রাপ্ত-অবুঝ শিশু-কিশোরদের জীবন বিধ্বংসী মাদক-অস্ত্র-অসামাজিক কর্মে হাইব্রিড রাজনীতিবিদদেরও বাহিনীভিত্তিক কর্মযজ্ঞ পুরো দেশকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। সরকার-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নানা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এদের নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা-আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর রয়েছে বলে বক্তব্য উপস্থাপিত হলেও বাস্তবতায় এর কার্যকারিতা তেমন ফলপ্রসূ নয়।
২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় ছাত্র হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়ার পর দেশব্যাপী এর দ্রুত বিস্তার অতিশয় দৃশ্যমান। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’র সংঘাতের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। এসব অপরাধী সংগঠনের সঙ্গে কালক্রমে যুক্ত হয়েছে ‘বিগবস’, ‘কাশ্মীরি গ্রুপ’, ‘টিকটক অ্যাপ’, ‘ফার্স্ট হিটার বস’, ‘এফবিএএইচ’, ‘মোল্লা রাব্বি’, ‘স্টার বন্ড’ নামের বিভিন্ন কিশোর গ্যাং। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রুপে রয়েছে ভিন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল কাটার ধরন ও রঙের ভিন্নমুখী ব্যবহার। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনায় দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান অসমতা ও বৈষম্য সমাজে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ফলে ১৯৫৫ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক কিশোর অপরাধী এবং গ্যাংয়ের উত্থান ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা সহজে প্রাপ্তির কারণে কিশোররা বেপরোয়াভাবে তাদের স্বাধীন সত্তার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, রাজধানীসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং এ গ্যাংগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে শতাধিক গডফাদার। পর্দার আড়ালে থেকে এসব কদর্য চরিত্রের ব্যক্তিরা কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকায় মাস্তানি-চাঁদাবাজি-এলাকা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে যাদের বেশির ভাগ সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ৫০ জন। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা আছে ৭৮০টি এবং এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৯০০ জন। সম্প্রতি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে রাজধানীতে সক্রিয় এলাকাভিত্তিক ৮০টি কিশোর গ্যাংয়ের সুনির্দিষ্ট তালিকা করা হয়েছে। এই ৮০টি দলের ৮০ জন গডফাদার রয়েছে বলেও জানায় র্যাব কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ শতাধিক কিশোর গ্যাং গডফাদারদের নামের তালিকা তৈরি করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তন্মধ্যে ২৫টির সঙ্গে কিশোর গ্যাং সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। নামে কিশোর গ্যাং দলের এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তারা ছিনতাই-চাঁদাবাজি-মাদক ব্যবসা-জমি দখলে সহায়তা-ইন্টারনেট সংযোগ-কেবল টিভি ও ময়লা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ-উত্ত্যক্ত করা-যৌন হয়রানি-হামলা-মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত। বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে। পুরো দেশে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তার হওয়ার দৃষ্টান্তও নেহাত কম নয়। শুধু ২০২৩ সালে র্যাব ৩৪৯ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করে। পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান সাঁড়াশি অভিযানে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় আড়াইশ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে র্যাব জিরো জিরো সেভেন-জাউরা-বাবা-ভোল্টেজ-ডি কোম্পানি-বয়রা জাহাঙ্গীর গ্রুপের ছয় দলনেতাসহ ৩৭ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
বিশ্লেষকদের দাবি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গ্যাংয়ের নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবার কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় রাজনীতিবিদদের। কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় নষ্ট চরিত্রের ঘৃণ্য ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে কিশোরদের ব্যবহার করছে। কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে আছে স্থানীয় পর্যায়ের অপরাধী চক্র ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতা। সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর আইনগত সহায়তাও দেয় আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া রাজনৈতিক নেতারা। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, কিশোরদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রথমে বিরোধ ও জোট বাঁধার প্রবণতা তৈরি হয়। সেখান থেকে প্রসারিত হয় গ্যাং বিস্তার। তাদের প্রশ্রয় দেয় এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বড় ভাইয়েরা। এক সময় সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার ও স্থানীয় মুরব্বিদের ভূমিকা ছিল। তারা কিশোরদের বখাটেপনা প্রশ্রয় দিতেন না। এখন মুরব্বিদের জায়গাটি নিয়েছে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। সচেতন মহলের ধারণা, রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য এই অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে চিহ্নিত। যারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করবেন তাদের মধ্যে একটি অংশ অপরাধ সৃষ্টির অংশ হিসেবে কাজ করছেন এবং সেখান থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মহান জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় বিরোধীদলীয় চিফ হুইফ কিশোর গ্যাং ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, “যারা এসব কাজে জড়িত; সেটা সরকারি দলের হোক বা পুলিশের হোক সারাদেশের মানুষ বিশেষ করে ঢাকা শহরের মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এদের বিরুদ্ধে একটি ‘ড্রাস্টিক অ্যাকশন’ নেওয়া প্রয়োজন।” এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা-১৮ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাং ও চাঁদাবাজদের দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অতিসম্প্রতি র্যাবের মহাপরিচালক মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ‘অলআউট অ্যাকশনে’ যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ হচ্ছে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আপনারা জানেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে এই কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার খুব বেড়ে গিয়েছিল। এতে র্যাব অভিযান পরিচালনা করে বেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কিশোর গ্যাংকে কীভাবে বিনাশ করা যায়। পাশাপাশি যারা তাদের পরিচালনা করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা চাই, সমাজের মানুষ যাতে কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে রেহাই পায়।’
মোদ্দা কথা হচ্ছে, ধ্বংসের তলানিতে পৌঁছানোর আগেই জনসংখ্যার তুলনায় স্বল্পসংখ্যক এসব কিশোর অপরাধী ও গ্যাং উপসংস্কৃতি নির্মূলে বিকল্প হিসেবে পর্যাপ্ত সংশোধনের ব্যবস্থা, কাউন্সেলিং-নিরাময় কেন্দ্র, পরিবারের যথোপযুক্ত মনোযোগ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। একই সঙ্গে অপরাধীদের ও তাদের ইন্ধন-উৎসাহদাতাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা না গেলে এই কিশোর গ্যাং উপসংস্কৃতি মহামারীর রূপ ধারণ করবেÑ নি:সন্দেহে তা বলা যায়। ব্যক্তি-সমাজ-পরিবারসহ জাতিরাষ্ট্রের সব নাগরিকের সতর্কতা ও সচেতনতা এবং শিশু-কিশোর সন্তানদের জীবন প্রক্রিয়ার গতিবিধি প্রতিনিয়ত নিগূঢ় তত্ত্বাবধান-পর্যবেক্ষণে রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিবিড় ভালোবাসা-আদর-স্নেহ এবং তাদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনশীলতা পরিশীলিত-যৌক্তিক অনুষঙ্গ অনুসরণে সমস্যার সমাধানকল্পে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই সমস্যা উত্তরণ ও পরিত্রাণের পথ-পন্থা উদ্ভাবনে সহায়ক হতে পারে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে বাড়ছে কিশোর গ্যাং-এর তৎপরতা
ড. খ. ম. রেজাউল করিম
বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর সর্বত্র নানা সংকট সমাজ জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে একদিকে পুরাতন সমস্যাগুলো যেমন জটিল রূপ ধারণ করছে, তেমনি নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সমাজে নতুন সংকটের নাম কিশোর গ্যাং। দেশে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। একে অপরের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে কয়েকজন কিশোর মিলে পাড়া বা মহল্লায় বিভিন্ন নামে গ্যাং গড়ে তুলছে। মূলত নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মাদক, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে বিরোধের কারণে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এসব কিশোর এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, মারামারি, মাদকব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেবল টিভি (ডিশ) ব্যবসা, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সমাজ গবেষকরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে এসব গ্যাং দিনকে দিন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। ফলে বিশেষ করে শহর এলাকায় মানুষের নিরাপদ বসবাসের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠেছে এসব বাহিনী।
ইউনিসেফ-এর এক হিসাবে বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা অস্বাভাবিক না হলেও, অনাকাক্সিক্ষত। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গে কিশোর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে শিল্পায়ন ও নগরায়নের গতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে দেশে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের সাম্প্রতিক তথ্যানুুযায়ী ঢাকা শহরে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে তাদের ৪০ শতাংশই কিশোর। আর কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির মধ্যেই বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে কিশোর গ্যাং কালচার। জানা যায়, ২০১৮ সালে উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর গ্যাং কালচার শব্দটি জনপ্রিয়তা পায়।
জানা যায়, কিশোর গ্যাং-এ জড়িতদের গড় বয়স ১০-১৭ বছর। অন্য এক তথ্যমতে, নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যের গড় বয়স ১৮ বছরের বেশি। কিশোর গ্যাং- এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের একটি দলীয় নাম, একটি স্থান, আলাদা ড্রেস কোড থাকে, চুলের স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। এদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ও স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। এছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্তের ও লেখাপড়া না জানা কিশোর-তরুণও এ দলে আছে। পুলিশ প্রতিবেদন-২০২২ অনুযায়ী, দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। অন্য এক হিসাব মতে, দেশে ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কিশোর গ্যাংবিষয়ক ৩২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা সূত্রে ১১০টি গ্যাংকে শনাক্ত করা গেছে, যাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। ওই সময়ে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রায় ৫৪টি কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭১০ জন। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব বিভাগ, জেলা, থানা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় গড়ে ওঠা অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার কিশোর গ্যাংয়ের দাপটে ও আতঙ্কে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার, শহর-বন্দর সর্বত্র। এক হিসাব অনুযায়ী শুধু রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রামে ৫৭টি এবং মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। এসব বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ৫০ জন। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব গ্যাং একদিনে গড়ে ওঠেনি। সাধারণত কিশোরদের মধ্যে ‘অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব দেখা যায়। ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ, নেতৃত্ব ও ক্ষমতার আকাক্সক্ষা, সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের গ্যাং-এর জন্ম দিচ্ছে। সমাজ মনোবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল টার্ডের ধারণা, অনেক সহজ-সরল, নিরপরাধ কোমলমতি কিশোর অপরাধীকে অনুকরণ করে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। তার মতে, অনুকরণের প্রথম শিকার হয় নবীনরা এবং তারা সহজেই অপরাধের ফাঁদে পড়ে। টেলিভিশন, ভিডিও, সিনেমা, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক, চিন্তা-ভাবনা, দর্শন আকর্ষণ সহজেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এভাবে অনেক কিশোর অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ পরিবারের সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের তেমন মনোযোগ নেই। তারা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। কারণ তারা সমাজে অর্থ-বিত্তশালীদের মূল্যায়ন বেশি হতে দেখছেন। একটা সময় সমাজে ভালো ছাত্র ও শিল্পীদের যথেষ্ট কদর ছিল। এখন আর তা দেখা যায় না। ফলে কিশোরদের সামনে কোনো রোল মডেল নেই। এছাড়া কিশোররা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেও বয়সের কারণে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। তাদের পাঠানো হয় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে অনেকেই সংশোধিত হওয়া তো দূরের কথা, তারা আরও ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে বেরিয়ে আসে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, আপনার সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি সন্তানকে সময় দেওয়াও জরুরি। তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মার অবস্থান তুলে ধরা। সহজ করে বললে অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের বন্ধন খুবই জরুরি। এই বন্ধন যত শিথিল হয়, সন্তান তত বাইরের জগতে ছুটবে, তখন তাকে ফেরানোর কোনো রাস্তা থাকবে না।
সম্প্রতি পুলিশ কিশোর গ্যাং-এর হালনাগাদ তালিকা তৈরি করছে। কয়েক বছর আগের চেয়ে বর্তমান এই সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের বাস্তবতায় কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সংশোধনের সুযোগ রেখে আইন প্রয়োগ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধকরণ, সামাজিক অনুশাসনের পরিধি বৃদ্ধি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধু-বান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পাড়ার মুরব্বিরা শাসন করতেন। এখন তারাই ভয় পান। এছাড়া সমাজ কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও বিশ্বায়নের সঙ্গে অভিভাবকরা অনেক সময় তাল মেলাতে পারছেন না। সন্তান কী করে সময় কাটায়, ডিজিটাল ডিভাইসে কী করে তারা বুঝে উঠতে পারেন না। এছাড়া কিশোররা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা থাকলেও সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর তাতে আগ্রহ নেই। তাই যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও সে সবের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নিচে কিশোর গ্যাং দ্বারা কৃত অপরাধ প্রতিরোধে কতিপয় সুপারিশ তুলে ধরা হলোÑ
১. কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
২. দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকা দরকার।
৩. কিশোর অপরাধ রোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্মিলিত উদ্যোগ।
৪. কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি এবং ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা দরকার।
৫) মূল্যবোধ সুরক্ষায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নৈতিক শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
৬. আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজে মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার সামাজিক আন্দোলনও জোরদার করা জরুরি।
৭. কিশোর অপরাধ রোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি ও মসজিদের ইমামদের সমন্বয়ে নিয়মিত মতবিনিময়ের আয়োজন করা যেতে পারে।
প্রতিটি দিন পত্রিকার পাতা ওল্টাতেই প্রায়ই চোখে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্ব। ১২ নভেম্বর জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমাদের সময়ের শেষ পাতায় চোখ পড়ে, যশোর শহরে ৯ নভেম্বর রাত ৮টায় বড়বাজারে প্রকাশ্য লোকারণ্যে এক কিশোরকে দুই কিশোর উপর্যুপরি চাকু চালায়। কিন্তু কেউ এগিয়ে না এলে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যায় কিশোর রাজিম খান সাজেদ। ছেলেটি দশম শ্রেণিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি কাপড়ের দোকানে বিক্রয় সহকারীর কাজ করত। অথচ এর কয়েকদিন আগেই ১৬ অক্টোবর রাতে যশোর শহরের মুজিব সড়কে প্রকাশ্যে খুন হয় কিশোর রিপন। এভাবে প্রতিটি মাসেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিশোরদের হাতে সংঘটিত হচ্ছে একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা।
দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা পেশায় থেকে অনায়াসে বলা যায়, কলেজে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী হলেও ৫ শতাংশ আছে যারা পড়াশোনায় অমনোযোগী যতখানি; ঠিক ততটাই তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক, কথা-বার্তা, চাল-চলন, গতি-বিধি; যা একেবারেই ছাত্রসুলভ নয়। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা অস্ত্র ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে। তাদের বুক চেতানো অঙ্গভঙ্গি বলে দেয় তারা যেন ভিন্ন কোনো প্রজাতির মানুষ। তাদের মাথার ওপর অলৌকিক কোনো ছায়া আছে। এ কারণে তারা ভূপৃষ্ঠে থাকা সব মানুষকে মানুষ বলে দৃষ্টিগোচর করতে নারাজ। আর এই ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বাকি ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শুধু নয়, শিক্ষকও অনেক ক্ষেত্রে আতঙ্কে থাকেন কখন কী ঘটনা ঘটে যায়! সবাই নিজস্ব কায়দায় নিজেদের আড়াল করে বাঁচিয়ে চলে।
পুত্রসন্তান আমারও আছে। ও এ বছরই ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা দেবে। ধরতে গেলে উপরে বর্ণিত কিশোরদের বয়সী। সন্তান স্কুলে যায়, শিক্ষকের কাছে পড়তে গিয়ে দিনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করে। আতঙ্কিত হয় মায়ের হৃদয় ছেলেটা আমার বাইরে গেল, ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছাবে তো? কোনো এমন ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নেশাগ্রস্ত হবে না তো? কোনো নানা রঙচঙে নামধারী কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আমার অবুঝ সন্তানের হাতে এমন কোনো ঘটনা ঘটবে না তো যাতে শুধু আমরা পিতা-মাতা কেন, পুরো জাতি কলঙ্কিত হয়! কখনো নিজে সঙ্গে যাই; কখনো বাসায় এলে গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখি, বিছানা বা তার ব্যাগ কিংবা রুমের সব জায়গা ঘেঁটে দেখি কোনো সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা। তবে ছেলে এতে চরম বিরক্ত হয়। তাকে বুঝিয়ে বলি। মায়ের মন তো! ভয়-আতঙ্কে মনটা ছোট হয়ে থাকে।
কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে ততই তাদের কিশোর গ্যাং যেন ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণ রূপে দেখা দিচ্ছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় খুন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ও ঘৃণিত অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং বেড়েই চলেছে। মূলত ২০১৭ সালে ঢাকার উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার নির্মমতা জনসমক্ষে আসে। তারা মূলত আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, এমনকি হত্যার মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। তারা ইয়াবা-ফেনসিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য সেবন করছে এবং আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করছে অবৈধ অস্ত্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে বয়সে আমাদের সন্তানদের পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, ওই বয়সে ছেলেমেয়েদের এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তি উপকরণের নাগাল পাওয়া, সঙ্গদোষ, যৌক্তিকতা বিচার না করেই সব আবদার পূরণ করা এবং সন্তান কী করছে, এ বিষয় পর্যবেক্ষণের অভাবসহ নানাবিধ কারণে কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এখন শুধু বৃদ্ধির প্রবণতার কথা বললেই চলবে না; বরং এটি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।
শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি ও তার প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো এই পরিবার। পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ ছাড়া গ্যাং কালচার রোধ করা সম্ভব নয়। কিশোর অপরাধ দমনে শুধু আইন প্রয়োগই নয়, সামাজিক সচেতনতা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে কিশোরদের মধ্যে বখাটেপনা ও নিত্যনতুন অপরাধপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমেই। এসব থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্নের জন্য ক্লাসে ছাত্রদের মনোযোগী করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে এবং শিশুদের প্রতিভা ও মেধা বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনÑ স্কাউটিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গণিত-বিজ্ঞানবিষয়ক অলিম্পিয়াড, বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে নিয়মিত।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে আমাদের অনেকের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এ হতাশা থেকেই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক ভিত্তি পোক্ত করতে অনেক সময়ই রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় লোকজন কিশোরদের ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তাদের অসামাজিক কার্যকলাপকে উসকে দিচ্ছে। এ জন্য রাজনৈতিক নেতাদেরও একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে হবে যাতে আগামী প্রজন্ম এভাবে তাদের হাতেই ধ্বংস হয়ে না যায়। কারণ নষ্ট প্রজন্ম নিয়ে নেতৃত্বে বেশিদূর এগোনো কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না। আরেকটি বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। তা হচ্ছে কিশোর সংশোধন কেন্দ্র। প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তাদের বড় কোনো শাস্তির পরিবর্তে পাঠানো হচ্ছে কিশোর সংশোধনাগারে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে এসে যদি আবার খারাপ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে! এ কারণে প্রয়োজন আইন সংস্কার ও কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা। এসবের পাশাপাশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচারের সময় ভিলেন হিসেবেই উপস্থাপন করাÑ যাতে কেউ উৎসাহিত না হয়, এ জন্য একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের প্রজন্মই আমাদের ধারক-বাহক। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষায় এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে সচেষ্ট হতে হবে পরিবারসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। তারা কার সন্তান, এটি দেখার বিষয় নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, তারা সবাই আমাদেরই সন্তান। তাদের সঠিক পথ দেখানো আমাদের সবার নৈতিক ও পরম দায়িত্ব। উন্নত ও স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম গঠন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের সামাজিক-মানবিক মানুষ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা।
ববি বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম