As-Salamu Alaikum. Welcome to Our SQSF-স্মার্ট লাইব্রেরী এবং কাউন্সেলিং (আত্নশুদ্ধির) সফটওয়্যার_SQSF-Smart Library and Counseling Software. Reg No: S-13909 www.sqsf.org ফোনঃ 01764 444 731
পারিবারিক বন্ধন প্রাণবন্ত রাখবেন যেভাবে
একেক বস্তুর মধ্যে জোড়া দেওয়ার একেক পদ্ধতি রয়েছে। যেমন দুই ইটের মধ্যে জোড়া দেওয়া হয় সিমেন্ট দিয়ে। দুই কাপড়ের মধ্যে জোড়া দেওয়া হয় সুঁই-সুতা দিয়ে। দুই কাঠের মধ্যে জোড়া লাগানো হয় পেরেক দিয়ে।
বোঝা গেল, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে জোড়া লাগানোর পদ্ধতি এক নয়। অনুরূপভাবে দুই অন্তরের মধ্যে জোড়া লাগানোর পদ্ধতি টাকা-পয়সা নয়। শিক্ষা কিংবা বংশও নয়। দুই অন্তরের মধ্যে জোড়া লাগানোর একটাই পদ্ধতি—দীন। দীন ও দীনদারিই পারে দুই অন্তরের মাঝে বন্ধন তৈরি করতে। আল্লাহর ভয়ই পারে উভয়ের মাঝে সম্পর্ক অটুট রাখতে।
اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. وَمِنْ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَٰجًا لِّتَسْكُنُوٓاْ إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَٰتٍۢ لِّقَوْمٍۢ يَتَفَكَّرُونَ
بارك الله لنا ولكم في القرآن العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
হামদ ও সালাতের পর!
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কিছু সময় বের করে এখানে বসার তাওফীক দিয়েছেন; এটা আল্লাহ তাআলার বিশেষ দয়া এবং মায়া। তিনি আমাদের প্রতি এ বিশেষ দয়া দেখিয়েছেন এজন্য আমরা তাঁর শোকর আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন
وَمِنْ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَٰجًا لِّتَسْكُنُوٓاْ إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَٰتٍۢ لِّقَوْمٍۢ يَتَفَكَّرُونَ
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে। (সূরা রুম : ২১)
মুহতারাম উপস্থিতি! বিভিন্ন স্থান থেকে চাহিদা এসেছে—পুরুষদের পক্ষ থেকেও, মা-বোনদের পক্ষ থেকেও যে, পারিবারিক জীবন কিভাবে ইনজয় করা যায়—এ সম্পর্কে যেন কিছু আলোচনা করা হয়।
একটা হল, কোনোভাবে পারিবারিক জীবন পার করে দেওয়া। আরেকটা হল, আল্লাহ তাআলা পরিবার নামক যে নেয়ামত দান করেছেন তা ইনজয় করা, ভোগ করা। আমাদের বড়রা সুখময় সংসারকে জান্নাতের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আর অশান্ত ও কলহ-বিবাদে জড়ানো পরিবারের তুলনা শুধু জাহান্নামের সঙ্গে চলে।
পরিবার কখন কারাগারে পরিণত হয়
এটা তো জানা কথা যে, যে পরিবারের মধ্যে দীনদারি থাকে সে পরিবারের রং অন্যরকম হয়। সুখ ও শান্তি সেখানের সাধারণ চিত্র হয়। বিপরীতে যে পরিবারে দীন থাকে না, ওই পরিবার ‘পরিবার’ হয় না; বরং কারাগার হয়। অশান্তি ও ঝগড়াঝাঁটি সেখানের সাধারণ চিত্র হয়।
আবার এটাও বাস্তবতা যে, পরিবার মানেই কিছু খুনসুটি থাকবে, কিছু মান-অভিমান থাকবে। যদি কোনো পরিবারে এগুলো না থাকে তাহলে তো ওই পরিবার দুনিয়াতে নেই; বরং জান্নাতে আছে! দুনিয়াতে বসবাস করছে—এর অর্থই হল, কিছু লড়াই থাকবে, কিছু মান-অভিমান থাকবে।
বিষয়টিকে বোঝানোর জন্য আমাদের বড়রা বলেন, মনে করুন, স্বামী যদি হাসান বসরী হয় আর স্ত্রী যদি রাবেয়া বসরী হয় তাহলেও দু’জনার মাঝে কিছু মান-অভিমান থাকাটা স্বাভাবিক।
যদি সুখী পরিবার পেতে চাই তাহলে আমাদের কাজ হল, এই স্বাভাবিক বিষয়কে স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা। এটাকে বাড়তে না দেওয়া। সুষ্ঠু সমাধানের পথ বের করে শান্তির ঠিকানায় জায়গা করে নেওয়া। যাকে বলা হয়, ইনজয় করা, নেয়ামত উপভোগ করা। অন্যথায় নেয়ামত আযাব হয়ে যাবে। পরিবার কারাগার হয়ে যাবে।
পরিবারগুলোর সমস্যা কী কী?
যাই হোক, প্রথমে জানা দরকার যে, বর্তমানের পরিবারগুলোর সবচাইতে বড় সমস্যা কী কী?
প্রথম সমস্যা: বনিবনা না হওয়া
এক্ষেত্রে প্রথমেই যে সমস্যাটি সামনে আসে তা হল, adjustment problem. অর্থাৎ, বনিবনা না হওয়া।
সত্যিকারের বিষয় হল, আপনারা যা দেখেন আমরা আরেকটু বেশি দেখি। কেননা, মসজিদের এই মিম্বারগুলো হল, আয়নার মতো। গোটা সমাজ এই আয়নার সামনে দন্ডায়মান। এখান থেকে গোটা সমাজ দেখা যায়, বোঝা যায়। আপনারা যাদের দেখলে সুখী মনে করেন আসলে তারা অনেক ক্ষেত্রে ততটা সুখী নয়। আমার চোখের সামনে এমন বহু পরিবার আছে, তাদের গাড়ি-বাড়ি, ধন-দৌলত সবই আছে। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা নেই। স্বামী স্ত্রী একই ছাদের নিচে বসবাস করে কিন্তু একজন আরেকজন থেকে যোজন যোজন দূরে। মনের মিল নেই। পরিবারের কারো সঙ্গে কারোর বনিবনা নেই। কে কখন আসে, কখন যায়, কখন শোয়, কখন খায় তার কোনো নিয়মনীতি নেই। অথচ সবাই একই ছাদের নিচে থাকে। কিন্তু একেকজন যেন একেক জগতের বাসিন্দা।
দ্বিতীয় সমস্যা: সময় নষ্ট করা
এখনকার পরিবারগুলোর আরেকটি সমস্যা হল, সময় নষ্ট করা।
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, আগেকার দিনের মা-বোনেরা সময়ের কত বরকত পেতো! আর এখন? সুইচ টিপ দিলেই গ্যাস, কাপড়ের জন্য ওয়াশিং মেশিন, ঠান্ডা করার জন্য ফ্রিজ, গরম করার জন্য ওভেন, মসলা তৈরির জন্য ব্লেন্ডার মেশিনসহ আরো কত কী! এর ওপরে আছে কাজের বুয়া—রেগুলার বুয়া, ছুটা বুয়া! এরপরও আমাদের মা বোনেরা সময় পায়না! এর কারণ হল, সময়ের বরকত নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
সময়ের বরকত নষ্ট হওয়ার চার কারণ
আমাদের পরিবারগুলোর সময়ের বরকত নেই সাধারণত চার কারণে।
১ . বিভিন্ন ডিভাইসের পিছনে সময় নষ্ট করার কারণে। যেমন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন, টেলিভিশন ইত্যাদির পিছনে সময় নষ্ট করার কারণে।
২ . বিভিন্ন ফ্যাশনের পিছনে সময় নষ্ট করার কারণে।
৩ . আড্ডা ও গল্পগুজবের পিছনে সময় নষ্ট করার কারণে। যেমন, একটা সিরিয়াল যদি মিস হয়ে যায়, এর অর্থ হল, মোবাইলের ৩০ মিনিটের ব্যালেন্স শেষ! কিভাবে? কারণ, আরেক ভাবীকে ফোন দিয়ে জানবে, জানাবে।
অথচ হাদীস এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
من حُسنِ إسلام المرءِ تركُهُ ما لا يعنيه
একজন ব্যক্তির ইসলামের পরিপূর্ণতার একটি লক্ষণ হল যে, তার জন্য জরুরী নয় এমন কাজ সে ত্যাগ করে। (জামে তিরমিযী : ২২৩৯)
৪. আরেকটি বড় কারণ হল সকাল বেলার ঘুম। হাদীস শরীফে যারা সকালে ঘুমিয়ে থাকে তাদেরকে أغبياءِ بني آدَمَ তথা মানবকুলের মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধ বলা হয়েছে। (সহীহ আল জামি’ : ৫৫৯৯)
এক স্কুল-শিশুর ঘটনা
বেশ আগে বিখ্যাত দায়ী মাওলানা তারিক জামিলের একটি বয়ান শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, কোনো এক স্কুলের পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন এসেছিল, তুমি জীবনে কী হতে চাও? এক বাচ্চা প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে লিখল, আমার জীবনে আমি স্মার্ট ফোন হতে চাই।
কারণ হিসেবে সে লিখে—আমি স্কুল শেষে যখন বাসায় যাই, বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেখি, বাবা স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তাই বাবা আমাকে সময় দেয় না। দু’ একটি কথা হয়ত বলে। তারপর বাবা আমাকে পাঠিয়ে দেয় মায়ের কাছে। তখন মাকেও দেখি স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত। মাও সময় দিতে চায় না। মা আবার পাঠিয়ে দেয় বাবার কাছে। তারা আমাকে আদর করে না। ধমক দেয়। তারপর আমিও স্মার্ট ফোনে গেম বা কার্টুন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমি লক্ষ করলাম, আমার বাবা-মায়ের কাছে আমার চেয়ে স্মার্ট ফোনের গুরুত্ব বেশি। সুতরাং আমি যদি স্মার্ট ফোন হতে পারি তাহলে বাবা-মায়ের আদর পাবো। তারা আমাকে গুরুত্ব দিবে। সময় দিবে। আদর করবে।
ঘটনাক্রমে উক্ত স্কুলের টিচার ছিল শিশুটির মা। মা নিজেই শিশুটির খাতা দেখছিল। যখন সে নিজের সন্তানের মনের এই আকুতি পরীক্ষার খাতায় পড়ছিল তখন শুভবুদ্ধির উদয় হল। মনের অজান্তেই কেঁদে ফেলল এবং স্বামীর কাছে পরীক্ষার খাতাটি নিয়ে তাকে বলল, দেখো, এসব ডিভাইস আমাদেরকে নিজেদের সন্তানদের থেকে কত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে!
বর্তমানের ফ্যাশন শয়তানকে আকৃষ্ট করার নীরব প্রতিযোগিতা
অনুরূপভাবে ফ্যাশনের পিছনে সময় নষ্ট করা মা-বোনদের একটি বিশ্রী অভ্যাস। জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন মার্কেটিং পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা বেশি করে। একটা সিরিয়ালে একটা পোশাক দেখলে কিংবা কোনো ভাবীর কাছে নতুন কিছু দেখলে এবার সেটা খোঁজাখুঁজি শুরু করে প্রথমে অনলাইনে। আলিবাবা, দারাজ, অ্যামাজন, ফেসবুকের বিভিন্ন পেজসহ কত জায়গায় যে ভার্চুয়ালভাবে ঘুরে বেড়ায়! এতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়।
কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে তো আর কথাই নেই। শুরু হয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফ্যাশন শো। অথচ স্বামীর সামনে সাজবে না। এখনকার মেকআপ, ড্রেসাপ হল, কে কত বেশি আঁটসাঁট পোশাক পরবে, কে কত বেশি আটা-ময়দা মাখবে এবং এর মাধ্যমে কে কত বেশি শয়তানকে আকৃষ্ট করতে পারবে; এর নীরব প্রতিযোগিতা। এখনকার কোনো মেকআপই পারফিউম ছাড়া নেই। স্ট্রবেরি ফ্লেভার, লেমন ফ্লেভার, চকলেট ফ্লেভার আরো কত ফ্লেভার যে আছে! আর এসব মেখে যখন নারীরা ঘর থেকে বের হয়, হাদীসে আছে, শয়তান তার দিকে আকৃষ্ট হয়। বিশেষ মনোযোগ দেয়। নবীজী ﷺ বলেছেন
فإذا خرجتِ استشرفها الشَّيطانُ
যখন সে এভাবে বের হয়ে তখন শয়তান তার উপর ভর করে। (তিরমিযী : ১১৭৩)
হাদীসে উল্লেখিত শব্দ استشرف এর আরেক অর্থ হচ্ছে, উঁকি দিয়ে দেখা, চোখ তুলে তাকানো, অর্থাৎ শয়তান তার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। তার ফলোয়ার হিসেবে তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়। ফলে সে তখন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; বরং তাকে ড্রাইভ করে শয়তান। শয়তান তাকে পরিচালনা করে।
কোথায় সমাধান?
মুহতারাম উপস্থিতি! পারিবারিক যাবতীয় অশান্তির মূলে উক্ত সমস্যাগুলোই প্রধান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় আসলে সমাধান? বিশেষ করে adjustment problem অর্থাৎ, বনিবনা না হওয়ার সমাধান কোন পথে? বিচ্ছেদই কি চূড়ান্ত সমাধান? এ বিষয়ে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। তবে যে কথাটি চির সত্য তা হচ্ছে, দীনদারিই এর আসল সমাধান। পারিবারিক সুখ-শান্তি, মূল্যবোধ এবং সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দীনদারি তথা ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার বিকল্প নেই।
পরিবারের মাঝে দীনী কিছু common activities থাকা
এজন্য এ সুবাদে প্রথমেই যে পরামর্শ দিব তা হল, প্রতিটি পরিবারের মাঝে কিছু দীনী common activities থাকা চাই। যেমন, প্রতিটি ঘরেই তা’লিমের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানে পরিবারের সকল সদস্য উপস্থিত থাকবে। এর জন্য এমন একটা সময় নির্ধারণ করে নেওয়া, যেন ওই সময়ে পরিবারের সকল সদস্য উপস্থিত থাকতে পারে। যেন নারী এবং শিশুরা দীনি মেজাজে গড়ে ওঠতে পারে।
সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের রাসূলের যুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষা দিতাম, যেমনিভাবে তাদেরকে আমরা কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতাম। (তারবিয়াতুল আওলাদ ফিল ইসলাম : ৩১৮)
অথবা এমনও হতে পারে যে, মাঝে মাঝে একজন আমলধারী আলেমকে দাওয়াত দিলেন। সেখানে পরিবারের সকল সদস্য উপস্থিত থাকল। আর তিনি সকলের উদ্দেশ্যে কিছু নসিহত করলেন।
অথবা এর সুরত এমন হতে পারে যে, পরিবারের সকল সদস্য মিলে ফজরের পরে একসঙ্গে বসে কুরআন তেলাওয়াত করলেন।
অথবা এমনও হতে পারে যে, সকলে মিলে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বসে একসঙ্গে কিছু জিকির করলেন, দোয়া করলেন।
অথবা এমনও হতে পারে যে, সপ্তাহে একদিন যেমন সোম কিংবা বৃহস্পতিবার সকলে মিলে রোজা রাখলেন। তারপর সকলে মিলে একসঙ্গে ইফতার করলেন। ইফতারের আগে দোয়া কবুল হয়। ওই সময় সকলে মিলে একসঙ্গে দোয়া করলেন।
পরিবারের মাঝে এ জাতীয় দীনী common activities পরিবারের সদস্যদের মাঝে Bonding তথা বন্ধন বৃদ্ধি করবে। একে অপরের অনুভূতি বোঝা সহজ হবে।
শিক্ষক হিসেবে আমাদের এই অভিজ্ঞতা আছে যে, যে ছেলেটা বেয়াড়া টাইপের হয়, খোঁজ নিলে দেখা যায়, এর বড় কারণ হল, পরিবারের মধ্যে দীন চর্চা না থাকা। ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকা।
বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ
পরিবারগুলোতে বনিবনা না হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, বউ-শাশুড়ির মধ্যে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী। এটা আমার কথা নয়। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে একটি ইনস্টিটিউট প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বেশ কিছু পরিবার নিয়ে গবেষণা করেছিল, সেখানে দেখানো হয়েছিল, ৬০% নারী পারিবারিক অশান্তির জন্য শাশুড়িকে দায়ী করেছিল কিংবা শাশুড়ি বৌমাকে দায়ী করেছিল। অবশিষ্ট ৩০% নারীর অভিযোগ ছিল স্বামীর বিরুদ্ধে কিংবা স্বামীর অভিযোগ ছিল স্ত্রীর বিরুদ্ধে। আর ১০% নারী-পুরুষের অভিযোগ ছিল অন্যান্য বিষয়ে।
সুতরাং বোঝা গেল, বউ-শাশুড়ির যুদ্ধই পরিবারগুলোতে সবচেয়ে বেশি।
এই যুদ্ধের সমাধান কী?
এ সুবাদে আমার প্রথম উত্তর হবে, আগে যা বলেছি তা-ই। অর্থাৎ যদি উভয়ের মাঝে দীন চলে আসে, উভয়ের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয় চলে আসে তাহলে এই যুদ্ধ শান্তিতে রূপ নিবে। উভয়ের মাঝে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা তৈরি হবে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا
তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। (সূরা আলি ইমরান : ১০৩)
দুই অন্তরের মধ্যে জোড়া লাগানোর পদ্ধতি
আমাদের বড়রা বলেন, একেক বস্তুর মধ্যে জোড়া দেওয়ার একেক পদ্ধতি রয়েছে। যেমন দুই ইটের মধ্যে জোড়া দেওয়া হয় সিমেন্ট দিয়ে। দুই কাপড়ের মধ্যে জোড়া দেওয়া হয় সুঁই-সুতা দিয়ে। দুই কাঠের মধ্যে জোড়া লাগানো হয় পেরেক দিয়ে।
বোঝা গেল, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে জোড়া লাগানোর পদ্ধতি এক নয়। অনুরূপভাবে দুই অন্তরের মধ্যে জোড়া লাগানোর পদ্ধতি টাকা-পয়সা নয়। শিক্ষা কিংবা বংশও নয়। দুই অন্তরের মধ্যে জোড়া লাগানোর একটাই পদ্ধতি—দীন। দীন ও দীনদারিই পারে দুই অন্তরের মাঝে বন্ধন তৈরি করতে। আল্লাহর ভয়ই পারে উভয়ের মাঝে সম্পর্ক অটুট রাখতে।
শাশুড়িকে হতে হবে মা, বৌমাকে হতে হবে মেয়ে
দ্বিতীয়ত, ইসলামের শিক্ষা হল, শাশুড়ি মনে করবে, একটা মেয়ে তার মা-বাবা ভাই-বোন ও অন্যান্য আপনজন রেখে আমাদের পরিবারে এসেছে। এটা তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ। সুতরাং এখন থেকে সে আমাদের পরিবারের মেয়ে—আমার মেয়ে।
অনুরূপভাবে স্ত্রী মনে করবে, বিয়ের আগে আমার মা ছিলেন একজন। বিয়ের পর আমার জীবনে আরেকজন নতুন মা এসেছেন—শাশুড়ি মা।
এভাবে শাশুড়ি যদি পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো আদর ও মমতায় আবদ্ধ করে নিতে পারেন, তার সুখ, আনন্দ ও সুবিধার প্রতি সবিশেষ মনোযোগ দেন, অনুরূপভাবে স্ত্রী যদি স্বামীর মাকে নিজের মায়ের মতো সম্মান ও সমীহের চোখে দেখে, মনপ্রাণে তাকে ভালোবাসে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যত্নকে নিজের জন্য পরম সৌভাগ্য মনে করে তাহলে বউ-শাশুড়ির সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যাবে। তিক্ততা অনেকাংশে কমে যাবে।
শাশুড়িকে বলছি
মূলত শাশুড়ি ও বৌমা তখনই দূরে সরে যায় যখন তাদের সম্পর্ক সেরেফ বউ শাশুড়ির মতো থাকে। এজন্য আবারও বলছি, বৌমাকে মেয়ের মত করে দেখতে হবে। অনেক শাশুড়ি আশা করেন, তার বৌমা ঘরে পা দিয়েই পাকা গৃহিণীর মত সব কিছু সামলাবে । কিন্তু এভাবে ভাবলে চলবে না। আপনার বৌমা আপনার চেয়ে অনেক ছোট—বয়সে এবং অভিজ্ঞতায়। সুতরাং বৌমাকে স্নেহ ও মমতা দিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেয়া যাবে না।
সতর্ক থাকতে হবে, মেয়ে হলে এমন করে বলতে পারতেন বা করতে পারতেন? বৌমায়ের পক্ষ থেকে এই ধরনের কথার তলে কখনই পড়া যাবে না। বরং ধৈয্যর্ ধরে তার সঙ্গে নরম আচরণ করুন।
নবীজী ﷺ বলেছেন
مَنْ أُعْطِىَ حظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ ، فقدْ أُعْطِىَ حظَّهُ مِنَ الخيرِ ، ومَنْ حُرِمَ حظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ ، فَقَدْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الخيرِ
যাকে নমনয়ীতার অংশ দেয়া হয়েছে তাকে কল্যাণের অংশ দেয়া হয়েছে। নমনীয়তার অংশ হতে যাকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে কল্যাণের অংশ হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। (তিরমিযী : ২০১৩)
বৌমাকে বলছি
আপনাকেও শাশুড়ির মেয়ের মতো হতে হবে। মেয়ে কিন্তু প্রত্যেকটা কথায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকে না। সুতরাং বিনয়ী হোন। মানুষের হৃদয়ের প্রবেশ করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে বিনয়ী হওয়া। শাশুড়ি মুরুব্বি হিসেবে কোনো কথা বললে মনের বিপরীতে হলেও মেনে নিন। নিজের মা কোনো শক্ত কথা বললে যেমন সহজভঙ্গিতে ‘ও হতেই পারে’ বলেন, এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই ভাবতে চেষ্টা করুন। মনে করুন, মা তার মেয়েকেই তো বলেছে।
নবীজী ﷺ বলেছেন
وما تَواضَعَ أحَدٌ للَّهِ إلَّا رَفَعَهُ اللَّهُ
কেউ আল্লাহর সম্ভষ্টি লাভে বিনয়ী হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম : ২৫৮৮)
মনে রাখবেন, ভালোবাসা ও যত্ন হচ্ছে বিনিময়ের ব্যাপার। এগুলো এক পাক্ষিকভাবে হয় না। দু’পক্ষ থেকেই আন্তরিকতা ও চেষ্টা থাকতে হয়।
ঝগড়া ক্ষমার মাধ্যমে ইতি টানুন
উক্ত দুই পরামর্শ মেনে চলার পরেও আমি একথা বলছি না যে, কোনো ঝগড়াঝাঁটি মোটেও থাকবে না। কেননা, একসঙ্গে থাকতে গেলে টুকটাক মনোমালিন্য হবেই। আপন মা-মেয়ের মধ্যেও হয়। তবে এক্ষেত্রে বউ-শাশুড়ি উভয়ের প্রতি তৃতীয় পরামর্শ হল, আগের দিনের ঝগড়ার জের টেনে পরের দিন অশান্তি শুরু করবেন না। যা হয়েছে, তা ভুলে যান। রাতে ঘুমানোর আগেই একে অপরকে মাফ করে দিন। নতুন একটা সকাল, নতুনভাবে শুরু করুন। একে অপরকে ক্ষমা করে দেয়ার মাধ্যমে ঝগড়ার ইতি টানুন।
যে সুন্নাহ পালনে নবীজির সঙ্গে জান্নাতে থাকা যাবে
দেখুন, এটি এমন একটি সুন্নাহ যে, এর কারণে নবীজির সঙ্গে জান্নাতে থাকা যায়। আনাস রাযি. বলেন, নবীজী ﷺ একদিন আমাকে বলেছেন
يَا بُنَىَّ إِنْ قَدَرْتَ أَنْ تُصْبِحَ وَتُمْسِيَ لَيْسَ فِي قَلْبِكَ غِشٌّ لأَحَدٍ فَافْعَلْ . ثُمَّ قَالَ لِي: يَا بُنَىَّ وَذَلِكَ مِنْ سُنَّتِي وَمَنْ أَحْيَا سُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي . وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِي فِي الْجَنَّةِ
হে বৎস! যদি তুমি পার, সকালে ও বিকালে তোমার অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ থাকবে না তবে তা—ই কর। তারপর তিনি বললেন, হে বৎস, এ হল আমার সুন্নাহ। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ জীবনে বাস্তবায়ন করল সে আমাকে ভালোবাসলো। আর যে আমাকে ভালোবাসলো সে জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকবে। (তিরমিযী : ২৬৭৮)
সুন্নাহটির চর্চা একটু কঠিন বৈকি! তবে...
দুঃখজনক ব্যাপার হল, আমাদের পরিবারগুলোতে এই সুন্নাহর চর্চা নেই। বরং দেখা যায়, সকাল হলেই নতুন উদ্যমে শুরু হয় আগের দিনের ঝগড়ার পুনরাবৃত্তি। অথচ শাশুড়ি যদি চিন্তা করে, আমি নবীজির সঙ্গে জান্নাতে থাকার জন্য বৌমাকে মাফ করে দিলাম। অনুরূপভাবে বৌমা যদি চিন্তা করে, আমি নবীজির সঙ্গে জান্নাতে থাকার জন্য শাশুড়ি আমার সঙ্গে অন্যায় করলেও তাকে মাফ করে দিলাম তাহলে ঝগড়া স্থায়ী হয় না। আর এটা তো জানা কথা যে, ঝগড়া গভীর হলে কেউই শান্তি পাবে না।
সুন্নাহটির চর্চা একটু কঠিন বৈকি! তবে শান্তিময় পরিবার পেতে হলে এটির চর্চা কেবল বউ-শাশুড়ি নয়; বরং পরিবারের সকলেরই মাঝে থাকা চাই।
রাতে ঘুমানোর আগে মিটমাট করে ফেলুন
একটি সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তাহল এই যে, নিয়ম হচ্ছে, পরিবারের টুকটাক ঝামেলা রাতে ঘুমানোর আগে মিটমাট করে ফেলা। যে দিনটি খুব খারাপ গিয়েছে, সেখান থেকেও কোনো ইতিবাচকতা নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করা। সতর্ক থাকা যে, ঘুমানোর আগে চলে যাওয়া দিনের কোনো ঝগড়া যেন পরের দিন সকাল পর্যন্ত বিস্তৃত না হয়। যেমন, একটু আগে বলেছি, বউ-শাশুড়ির ঝগড়া? রাতে ঘুমানোর আগেই মীমাংসা করে ফেলুন। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রীর কলহ? তাও রাতের ভেতরেই মিটমাট করে ফেলুন।
স্বামীর রাগের মোকাবেলা করার চমৎকার কৌশল
কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য থেকেও বিষয়টির গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, যৌবনকালে স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে সৃষ্ট ঝগড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে শারীরিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে মনের চাহিদা পূরণ করতে না পারা। অপর দিকে বিশেষ হেকমতের কারণে ইসলাম তালাকের অধিকার পুরুষদের দিয়েছে। এখন যদি স্বামী তার গোস্বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে তালাকের মতো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে! তাই ইসলাম স্বামীর রাগের মোকাবেলা করার জন্য একটা চমৎকার কৌশল শিক্ষা দিয়েছে। তা এই যে, রাগারাগী যতই হোক; রাতের বেলা স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ—সময় কাটাতে হবে। স্পর্শ, আলিঙ্গন, চুম্বন দিয়ে তাকে উত্তেজিত করে তুলতে হবে। এটা আল্লাহর দারুণ একটা নেয়ামত। এটা স্বামীর রাগ প্রশমনে খুব দ্রুত কাজ করে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَأَبَتْ أَنْ تَجِيءَ, لَعَنَتْهَا الْمَلَائِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ
স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিজ বিছানার দিকে আহ্বান করে তখন যদি স্ত্রী না আসে, তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তার উপর অভিশাপ করতে থাকে। (বুখারী : ৩২৩৭)
উক্ত হাদীসে حَتَّى تُصْبِحَ ‘সকাল পর্যন্ত’ শব্দ দ্বারা স্ত্রীকে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তালাকের মতো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, তাই রাতেই স্বামীর গোস্বা কাবু করে ফেলতে হবে।
একে অপরের সঙ্গে মুচকি হেসে কথা বলুন
বউ-শাশুড়ি উভয়ের প্রতি চতুর্থ পরামর্শ হল, সুখী পরিবার পেতে হলে একে অপরের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও মুচকি হেসে কথা বলুন। কেননা, একটু মুচকি হাসি দু’জনের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে। অপরদিকে গোমরামুখে থাকলে দূরত্ব তৈরি হবে। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, মুচকি হাসির মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে খুব সহজেই প্রবেশ করা যায়। মানুষের হৃদয়েও একটা তালা আছে। সেই তালার উত্তম চাবি হচ্ছে মুচকি হাসি। তাছাড়া মুচকি হেসে কথা বলা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর একটি চমৎকার সুন্নাহ। যতবার মুচকি হেসে কথা বলবেন, ততবার সাদকার সাওয়াব পাবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন
تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ
তোমার ভাইয়ের সাক্ষাতে মুচকি হাসাও একটি সাদকা। (তিরমিযী : ১৯৫৬)
শাশুড়ির প্রতি বিশেষ পরামর্শ
মুহতারাম হাজেরিন! উক্ত চার পরামর্শ ছিল বউ-শাশুড়ি উভয়ের প্রতি। এ পর্যায়ে বউমা ও শাশুড়ির প্রতি বিশেষ কিছু পরামর্শ তুলে ধরছি। প্রথমে আসা যাক, শাশুড়ির প্রতি বিশেষ পরামর্শ সম্পর্কে। শাশুড়ির প্রতি বিশেষ পরামর্শ একটাই; দিল বড় করতে হবে। আর দিল বড় করতে হলে তিনটি কাজ করতে হবে।
১. বউমার ভুলচুক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে অনেক শাশুড়ি আছেন, পুত্রবধুকে আপন করে নিতে পারেন না। পুত্রবধূকে বাড়ির সেবিকা বা চাকরানি মনে করেন। শাশুড়ি নিজের মেয়েকে এক চোখে দেখেন, পুত্রবধূকে ভিন্ন চোখে দেখেন। এজন্য একটি ব্যাপার স্পষ্ট থাকা দরকার যে, পুত্রবধূর ওপর শ্বশুর—শাশুড়ির সেবা করা ফরজ করা হয় নি। সুতরাং এজন্য তাকে শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতন করতে পারবেন না। বরং আপনার উচিত দিল বড় করা। তার ভুলচুক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। টুকটাক বিষয় নিয়ে বউমা’র সঙ্গে মতবিরোধ হতেই পারে। সেজন্য খামোখা ঝগড়াঝাঁটি করতে যাবেন না। চেষ্টা করুন তার মতকেও গুরুত্ব দিতে।
হাদিস শরিফে এসেছে, এক ব্যক্তি নবী ﷺ-এর নিকট এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কাজের লোককে প্রতিদিন কত বার মাফ করবো? তিনি চুপ থাকলেন। লোকটি আবার একই প্রশ্ন করলে এবারও তিনি চুপ থাকলেন। তৃতীয় বার প্রশ্ন করলে তিনি বলেন
اعفوا عنهُ كلَّ يومٍ سبعينَ مرَّةً
প্রতিদিন তাকে তোমরা সত্তর বার মাফ করবে। (আবু দাউদ : ৫১৬৪)
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যেখানে খাদেম বা চাকরকে প্রতিদিন সত্তর বার মাফ করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে এই মেয়েটি তো আপনার বউমা। আপনি বড়, সে ছোট। ভুল তো ছোটরাই করে। সুতরাং মাফ করে দিন।
২. পুত্র ও পুত্রবধূর সব কিছুতে নাক গলাবেন না
মনে রাখবেন, আপনার ছেলে এখন আপনার ছোট্ট বাবু নয়। সে এখন বড় হয়েছে। তার পার্সোনাল লাইফ আছে। আপনার পুত্র ও পুত্রবধূর দাম্পত্যজীবনে একে অন্যের প্রতি কিছু দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে। এখন যদি আপনি এসব বিষয়েও নাক গলানো শুরু করেন, তাদেরকে নিজেদের মতো করে দাম্পত্যজীবন উপভোগ করার স্পেস না দেন। যেমন, ছেলে তার স্ত্রীর জন্য কিছু আনলে আপনি যদি বলেন, এত দামীটা কেন আনলো কিংবা আমার জন্য বা আমার মেয়ের জন্য কেন আনলো না। অথবা ধরুন, ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে চায় আর আপনি এক্কেবারে ‘না’ করে বসলেন তাহলে মনে রাখবেন, সুখ ও শান্তি আপনার ছাদের নীচে কক্ষনো আসবে না। সুতরাং তাদের এসব পার্সোনাল বিষয়ে আপনাকে ছাড় দিতে হবে।
আসলে উক্ত সমস্যার অন্যতম কারণ হল, ছেলেকে বিয়ে করানোর পর মা মনে করে, এই বুঝি ছেলে পর হয়ে গেল। বৌমাকেই বেশি গুরুত্ব দিবে। আর বোধ হয় তাকে সেভাবে পাত্তাও দিবে না। ছেলের অধিকারবোধ নিয়ে তারা আশঙ্কায় ভোগেন বিধায় এমনটি করে থাকেন। এজন্য এক্ষেত্রে মায়ের উচিত, অন্তরটাকে বড় করা।
৩. পুত্রবধূর ভালো গুণগুলোর প্রশংসা করুন
কিছু শাশুড়ি আছে বউমা’র ভালো গুণগুলোর প্রশংসা করা তো দূরের কথা; বরং পদে পদে তার ভুল ধরতেই ব্যস্ত থাকেন। ছেলের কাছে বউয়ের নামে গোপনে দুর্নাম করেন। নুন থেকে চুন খসলে ছেলের কাছে বিচার দেওয়ার ধমক দেন। নিজের মেয়েদের কাছে বলে বেড়ান। এমনকি বাইরের মানুষের সামনে অপদস্থ করেন। আর মেয়েদের কাছে বললে এটা তো স্বাভাবিক যে, এ দুর্নামগুলো তাদের স্বামীর কানেও পৌঁছে। তখন বউয়ের জন্য প্রধান বিচারপতি বনে যায় মেয়ে কিংবা তার স্বামী! যার কারণে আমাদের সমাজের অধিকাংশ ননদ তাদের ভাবীকে দাজ্জাল মনে করে। আর ভাবীরা ননদকে দাজ্জাল মনে করে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এটার জন্য অন্যতম দায়ী কিন্তু শাশুড়ি। অথচ শাশুড়ি যদি বউয়ের বদনাম না করে তার দোষগুলো গোপন করতো এবং তার ভালো গুণগুলোর প্রশংসা করতো, তাহলে পারিবারিক বিবাদ-কলহ অনেকাংশে কমে যেত। তাই শাশুড়িকে বলবো, আল্লাহকে ভয় করুন। বউয়ের গীবত করা, তাকে অপবাদ দেয়া থেকে দূরে থাকুন, তার দোষগুলো মায়ের মত করে লুকিয়ে রাখুন, তার ভালো গুণগুলোর প্রশংসা করুন; দেখবেন, আপনার সংসারে অশান্তি থাকবে না।
৩. নিজের মেয়েকে ও বউমাকে এক দৃষ্টিতে দেখুন
অনেক শাশুড়ি আছেন, ঘরে যদি কোনো অবিবাহিত মেয়ে থাকে তাহলে তার কোনো দোষ আছে বলে মনেই করেন না। মনে করে, সব দোষ কেবল পুত্রবধূর। এটা জঘন্য অন্যায়।
আইন দিয়ে জীবন-সংসার চলে না
মুহতারাম হাজেরীন! এবার আসা যাক, বউমা’র প্রতি বিশেষ কিছু পরামর্শ সম্পর্কে। একটু আগে বলেছিলাম, পুত্রবধূর ওপর শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা ফরজ করা হয় নি। এটা তো আইনের কথা। বাস্তবতা হল, আইনের রুক্ষ বাঁধনের ওপর ভিত্তি করে হয়ত ‘তালাক’ ঠেকানো যাবেÑযদিও অনেক সময় তাও সম্ভব হয় না; কিন্তু সুখ-শান্তি কখনই আসবে না। কেননা, এটা যেমন আইন তেমনিভাবে এটাও আইন যে, স্ত্রীকে তার মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া কিংবা ব্যবস্থা করে দেওয়া স্বামীর দায়িত্ব নয়। বরং ফকিহগণ এ পর্যন্তও বলেছেন, স্ত্রীর মা-বাবা সপ্তাহে মাত্র একবার আসবে, তাও মেয়েকে দূর থেকে দেখে চলে যাবে। তাদেরকে ঘরে বসিয়ে সাক্ষাৎ করতে দেয়া স্বামীর দায়িত্ব নয়।
সুতরাং আইনের এসব চৌহদ্দিতে পড়ে থাকা মানে অশান্তি ডেকে আনা। বরং বউমাকেও ভাবতে হবে যে, তাকেও একদিন শাশুড়ি হতে হবে। হতে হবে বৃদ্ধা। আর বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রবধূর কাছ থেকে কিরূপ আচরণ প্রত্যাশা করেÑএ প্রশ্ন নিজেকে করলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কেমন আচরণ করবে তার জবাব সে পেয়ে যাবে।
বউমা’র প্রতি বিশেষ পরামর্শ
তাই পারিবারিক সুখ-শান্তি যেন বিনষ্ট না হয় এ লক্ষে বউমা’র প্রতি সংক্ষেপে কিছু বিশেষ পরামর্শ পেশ করছি। যদি মানতে পারেন তাহলে ইনশাআল্লাহ শ্বশুরকে ‘বাবা’ এবং শাশুড়িকে ‘মা’ হিসেবে পাবেন।
১. শ্বশুর-শাশুড়ির আনুগত্য ও সেবা করুন
সুখের নীড় রচনা করতে হলে পুত্রবধূর উচিত স্বতঃস্ফূর্তভাবে যতটুকু সম্ভব শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা। একে নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করা।
দুঃখজনক হল, আজকাল এমন নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে যারা বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ির মসঙ্গে আর থাকতে চায় না বা তাদের সেবা করা নিজেদের উপর জুলুম মনে করে। অনেকে শ্বশুর-শাশুড়ি সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে স্বামীকে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধচারণ করতে উসকানি দেয় । উদ্দেশ্য হল, শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা থেকে অব্যাহতি পাওয়া।
অথচ ওই নারীই একসময় যখন আরেকজন মেয়ের শাশুড়ি হন, তখন চান নিজের পুত্রবধূ তার ভালোমন্দ খোঁজখবর নিক। সেবাযত্ন করুক। তাদের পাশেই থাকুক। এটা সম্পূর্ন দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন
لَا يُؤْمِنُ أحَدُكُمْ، حتَّى يُحِبَّ لأخِيهِ ما يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে। (মুসলিম : ৪৫)
২. শ্বশুরবাড়ির বদনাম বাবার বাড়িতে করবেন না
আপনার শ্বশুরবাড়ি হলেও সেটি আপনার স্বামীর নিজের বাড়ি। তাছাড়া বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িই হয়ে যায় নিজের বাড়ি। আর নিজের বাড়ির বদনাম কেউ সহ্য করতে পারে না। তাই শ্বশুরবাড়ির বদনাম করলে আপনার স্বামী রেগে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ সেই বাড়ির সব সদস্য তার আপনজন। তাই শ্বশুরবাড়ির বদনাম করবেন না। যদি সুযোগ পান তবে প্রশংসা করুন। এতে আপনার স্বামী খুশি থাকবেন। ভালো থাকবে আপনার সম্পর্ক। সংসারও সুখের হবে।
৩. মাঝে মাঝে শাশুড়িকে তার পছন্দের কিছু উপহার দেয়া
হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
تَهَادَوْا فَإِنَّ الْهَدِيَّةَ تُذْهِبُ وَغَرَ الصَّدْرِ
তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় করো। এর দ্বারা অন্তরের সঙ্কীর্ণতা ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ : ৯২৫০)
এই হাদিয়া নিজেই কিনে দিতে হবে তা জরুরি নয়। বরং মাঝে মাঝে স্বামীকে কিনে দিতে বলা। এতে শাশুড়ি মনে মনে অনেক খুশি হবেন এবং পুত্রবধূকে বেশী স্নেহ করবেন।
৩. শ্বশুরালয়ের বদনাম প্রতিবেশির কাছে করবেন না
এটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই প্রতিবেশি আপনার বদনামের কথা তার পেটে রাখবে না, এটা শত ভাগ নিশ্চিত। সন্দেহ নেই, যার কারণে আপনার সংসারে আগুন জ্বলে ওঠবে। তাছাড়া এর কারণে গীবতের গোনাহ যে হয় এটা আমরা সকলেই বুঝি।
৪. শাশুড়ির কাছ থেকে তার অতীতের সুখ-দুঃখের গল্প শুনবেন
এতে সম্পর্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। শাশুড়ির প্রতি এক প্রকার আবেগ তৈরি হবে। শাশুড়ি আপনাকে শাসন কিংবা বকাঝকা করে থাকলে তার কারণ কী; এটাও বোঝা সহজ হবে।
স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার দ্বারা পারিবারিক কল্যাণ পূর্ণ হয়
মুহতারাম হাজেরিন! ইতোপূর্বে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির একটি জরিপের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম যে, পরিবারগুলোতে ঝগড়া-বিবাদের বিষয়টি সবচাইতে বেশি দেখা যায়, বউ-শাশুড়ির মধ্যে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী। অথচ শান্তিময় জীবন যাপনে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কের বিকল্প নেই। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী লিখেছেন
تواد الزوجين به تتم المصلحة المنزلية
স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার দ্বারা পারিবারিক কল্যাণ পূর্ণ হয়।
তাই স্বামী-স্ত্রী যেন ঝগড়া এড়িয়ে চলতে পারে এপর্যায়ে এ লক্ষে উভয়ের প্রতি আরও কিছু পরামর্শ সংক্ষেপে পেশ করছি।
স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ১০ টি বিশেষ পরামর্শ
১. একে অপরের প্রতি শারীরিক বা মানসিক ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখুন
হাদিসে এসেছে
كان رسول الله ﷺ يُلاعبُ أهله ، ويُقَبلُها
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদি করতেন। (যাদুল মা’আদ : ৪/২৫৩)
তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর শারিরিক ঘনিষ্ঠতা অন্তরের খারাপ চিন্তা দূর করে দেয়। হাদিসে এসেছে
فَإِنَّ ذَلِكَ يَرُدُّ ماَ فِي نَفْسِهِ
এটি মন্দ পরিকল্পনা দূর করে দিবে। (মুসলিম : ৩৪৭৩)
২. একে অপরকে সিক্রেট নামে ডাকুন
একে অপরের জন্য এমন কোনো নাম ঠিক করুন, যেটা হবে সুইট, রোমান্টিক এবং সিক্রেট। যে নাম সঙ্গীর কানে গেলে রাগের সময়েও অন্তরে ভালোবাসার ঝংকার সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ভালোবেসে কখনো কখনো আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন। (ইবনে মাজাহ : ২৪৭৪)
তবে এই ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে আপনাদের এই একান্ত বিষয়টা যেন অন্যদের সামনে প্রকাশ না পায়। কারণ, তখন এই সুন্দর বিষয়টাই হয়ে যাবে নির্লজ্জতা।
৩. একে অপরকে বিশ্বাস রাখুন
সঙ্গীর প্রতি যদি আপনার বিশ্বাস খুবই জরুরি একটি বিষয়। এটা না থাকলে দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়া সুখময় হয় না। যে পরিবারে সন্দেহের রোগ বাসা বাঁধে সেখানে সুখের আশা করা বৃথা।
কাতাদাহ রহ. বলেন
لَا تَقُلْ رَأَيْتُ وَلَمْ تَرَ وَسَمِعْتُ وَلَمْ تُسْمِعْ وَعَلِمْتُ وَلَمْ تَعْلَمْ فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُكَ عَنْ ذَلِكَ كُلِّهِ
না দেখে দেখেছি বলো না। না শুনে শুনেছি বলো না। না জেনে জেনেছি বলো না। কেননা, এসব বিষয় সম্পর্কে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। (ইবনু কাসীর : ৫/৭৫)
ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন
سُوءُ الظَّنِّ يورِثُ الإنسانَ الأخلاقَ السَّيِّئةَ
অহেতুক ধারণা বিভিন্ন অসৎ চরিত্র সৃষ্টি করে। (কিতাবুর রূহ : ১/২৩৭)
৪. তৃতীয় পক্ষকে নাক গলানোর সুযোগ দিবেন না
আমাদের বড়রা বলেন, অধিকাংশ সময় স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয় তৃতীয় পক্ষের কারণে। আর যদি এই ঝগড়ার মাঝে আপনি নিজের ভাই বোন প্রমুখদের টেনে আনেন, তাহলে ঝামেলা গুরুতর আকার নিবে। যদি বন্ধুবান্ধবকে টানেন, তাহলে সম্পর্কের ইন্নালিল্লাহ হয়ে যাবে। তাছাড়া একটু আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, আপনাদের দাম্পত্য জীবনে আপনার বোনের কিংবা আপনার মায়ের মাধ্যমে আপনার স্ত্রীর বিচারক হয়ে উঠতে পারে আপনার ভগ্নীপতি। এটা কক্ষনো হতে দিবেন না। মনে রাখবেন, যারা অন্যের প্রাইভেট জীবন নিয়ে নাক গলায় এদের দৃষ্টান্ত রাস্তায় চলা বেয়াড়া ট্র্যাকের মত। ট্র্যাকের পিছনে যেমনিভাবে লেখা থাকে, ১০০ গজ দূরে থাকুন। অনুরূপভাবে এজাতীয় লোক থেকেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
৫. নিজেকে পরিপাটি রাখুন
পুরুষরা তাদের সঙ্গিনীকে সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। ঠিক একইভাবে তারা তাদের সঙ্গীকেও সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. বলতেন
إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَتَزَيَّنَ لِلْمَرْأَةِ ، كَمَا أُحِبُّ أَنْ تَتَزَيَّنَ لِي الْمَرْأَةُ
আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকা পছন্দ করি, যেমন পছন্দ করি আমার স্ত্রী আমার জন্য পরিপাটি থাকাকে। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা : ১৫৭১২)
৬. বলবেন কম, শুনবেন বেশী
আপনার সঙ্গী কী বলছেন, সেই কথাগুলি মন দিয়ে শুনুন। তাঁর দুটো কথা শুনেই নিজের মতামত দিতে শুরু করবেন না। এতে আপনাদের মধ্যে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।
আমরা সবাই নিজের কথা বলতে ভালোবাসি, কিন্তু বিপরীতের মানুষটির বক্তব্য শোনার কোনও ইচ্ছেই আমাদের মধ্য়ে থাকে না। তাই ঝগড়া-অশান্তিও বাড়ে। সব সময়ই যে আপনাকে ডিফেন্সিভ হতে হবে, এমন কোনও অর্থ নেই। বরং এবার থেকে শোনার অভ্যাসও গড়ে তুলুন। তাঁর মতামতকে সম্মান করুন। আপনার এই ব্যবহারে তিনিও খুশি হবেন।
জনৈক মনীষী বলেছিলেন
خلق الله لنا أذنين ولساناً واحداً لنسمع أكثر مما نقول
আল্লাহ আমাদেরকে কান দিয়েছেন দুটি আর জিহ্বা দিয়েছেন একটি, যেন আমরা বলার চেয়ে শোনার কাজ বেশী করি।
৭. মধুর সৃতিগুলো স্মরণ করুন
আপনার সঙ্গীর কোন কাজ বা আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। কারণ আপনি তাকে অনেক ভালবাসেন। সে এমনটি করবে বা বলবে তা আপনি কল্পনায়ও ঠাই দিতে পারছেন না! তাই খুব চটেছেন! একটু থামুন! কয়েক সেকেন্ড ভাবুন। তার সঙ্গে অতিবাহিত সুন্দর ভালবাসার ভাললাগার আচরণগুলো স্মরণ করুন। সেগুলোর সৃতিচারণ করুন। দেখবেন, রাগ কমে যাবে! স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
মানুষ ভুল করে। ভুল করতে পারে। ভাল—মন্দ স্বভাবের মিশ্রণেই মানুষের সৃষ্টি! একটি আচরণ খারাপ হলে তার অনেক আচরণ আছে যেগুলো মুগ্ধকর। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। আপনার ক্ষেত্রে। আপনার সঙ্গী/সঙ্গীণীর ক্ষেত্রে। সকলের ক্ষেত্রে! প্রত্যেকের উচিৎ তার সঙ্গীর উত্তম আচরণগুলো দেখা। মন্দগুলো মানবিক দুর্বলতা হিসেবে ক্ষমা করে দেয়া।
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন
لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً، إنْ كَرِهَ منها خُلُقًا رَضِيَ منها آخَرَ
কোনো মুমিন অন্য মুমিন নারী (পুরুষ)-কে চূড়ান্তভাবে ঘৃণা করতে পারে না। তার একটি স্বভাবে সন্তুষ্ট না হলে অন্য স্বভাবে অবশ্যই সন্তুষ্ট হবে। (সহীহ মুসলিম : ১৪৬৯)
৮. শয়তান কিন্তু জিতে গেল, আপনি হেরে গেলেন
এ বিষয়ে একটি চমৎকার হাদীস আছে। শুনলে অবশ্যই অভিভূত হবেন। আমরা হরহামেশা শয়তানকে জেতাচ্ছি। আর আমরা তার কাছে হেরে যাচ্ছি। হযরত যাবের রা. বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, ইবলিস তার সিংহাসন পানিতে স্থাপন করে। তারপর তার বাহিনীদের প্রেরণ করে। সর্বোচ্চ দুষ্কৃতিকারী তার সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করে। (দুষ্কৃতি শেষে) একজন এসে বলে : আমি এই এই কাজ করেছি। ইবলিস বলে, তুমি উল্লেখযোগ্য কিছুই করোনি! অপর একজন এসে বলে, আমি স্বামীর পিছনে লেগেই ছিলাম। একপর্যায়ে তার ও তার স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাই! তখন শয়তান তাকে কাছে টেনে নেয় আর বলে, হ্যাঁ তুমিই কাজের কাজ করেছ! এবং তার সাথে আলিঙ্গন করে! (সহীহ মুসলিম :৫০৩৯)
যখনই নিজেদের মাঝে কিছু হয়ে যাবে লক্ষ রাখতে হবে শয়তান যেন জিতে না যায়! সাবধান হতে হবে। আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
৯. বিরতি নিন
আপনি যদি মনে করেন যে আলোচনাটি উত্তপ্ত হতে চলেছে, তবে বিরতি নিন। কথায় আছে, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। সুতরাং এসময়ে প্রয়োজনে তাকে নিজ সম্মুখ হতে সরিয়ে দিন অথবা নিজেই অন্যত্রে সরে যান কিংবা অজু করে নিন বা কিছু পানি পান করুন, আপনার গাছপালা দেখুন। এসব একটি রিসেট বোতামের মতো কাজ করবে। আপনি যখন আবার রুমে প্রবেশ করবেন এবং আপনার সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলবেন, তখন দুজনেই নিজেকে শান্ত করবেন এবং সম্ভবত বন্ধুত্বপূর্ণভাবে কথা বলবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ.-কে বলা হল
اجْمَعْ لنا حُسنَ الخلق في كلمة
উত্তম চরিত্র সম্পর্কে এক কথায় আমাদের কিছু বলুন।
তিনি বললেন تركُ الغَضَب রাগ ত্যাগ করা। (জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম : ১/৩৬৩)
১০. সহজ উপায় খুঁজে বের করুন
ঝগড়াবিহীন কোনো দম্পতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনাদের সম্পর্কে যদি টুকটাক ঝগড়া না থাকে, তবে সেটি স্বাভাবিক নয়। তবে দিনদিন ঝগড়া বাড়তে দেওয়াও কোনো কাজের কথা নয়। কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তার সমাধান করার সহজ পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে যে, কোনোভাবেই যেন তালাকের প্রসঙ্গ সামনে না আসে। নুন থেকে চুন খসলে কিংবা নিজের পরিবারের কথায় প্ররোচিত হয়ে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়া কিংবা স্ত্রী স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া জঘন্য কাজ।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
لَيْسَ مِنَّا مَنْ خَبَّبَ امْرَأَةً عَلَى زَوْجِهَا
যে ব্যক্তি কোনো স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (সুনানে আবু দাউদ: ২১৭৫)
সুতরাং প্রতিশোধ নেয়া বা পরাস্ত করা থেকে বিরত থাকুন! কাকে পরাস্ত করবেন? কার উপর প্রতিশোধ নিবেন? সে তো আপনার জীবনসঙ্গী! এখানে প্রতিশোধ নয়, বরং ভালবাসা ও মমতা কাম্য! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। সাবধান হোন!
ত্রিশ বছরের বৈবাহিক জীবনে একবারও ঝগড়া-বিবাদ হয় নি
পরিশেষে চমৎকার ও শিক্ষণীয় একটা ঘটনা শুনিয়ে দিচ্ছি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. যখন বিয়ে করতে মনস্থির করেন তখন তার চাচীকে বলেন, ‘ওই শায়খের বাড়িতে দু’জন বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে, আপনি তাদের দেখে আসুন এবং তাদের সম্পর্কে আমাকে জানান।’
চাচী মেয়ে দুটিকে দেখে আসার পর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের কাছে তাদের বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। তিনি বাড়ির ছোট মেয়ের ব্যাপারে অনেক প্রশংসা করলেন। ফর্সা চেহারা, তার চোখ ও চুলের সৌন্দর্য, দীর্ঘতা বর্ণনায় পঞ্চমুখ হলেন।
ইমাম আহমদ তখন তাকে বড় মেয়েটির ব্যাপারে বলতে বললেন। বড় মেয়েটির ব্যাপারে তিনি অনেকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বললেন। অবিন্যস্ত চুল, খর্বকায় উচ্চতা, শ্যাম বর্ণ এবং একটি চোখে ক্রটি থাকার কথা উল্লেখ করলেন।
এরপর ইমাম আহমদ তাকে দু’জনের দীনদারির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে চাচী বললেন, ‘বড় মেয়েটি দীনদারির দিক থেকে ছোট মেয়ের তুলনার বেশ এগিয়ে।’
এ কথা শুনে ইমাম আহমদ বললেন, তাহলে আমি বড় মেয়েটিকেই বিয়ে করব।
বিয়ের ত্রিশ বছর কেটে যাওয়ার পর ইমাম আহমদের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলেন। দাফনের সময় ইমাম আহমদ বললেন, ‘ইয়া উম্মা আবদিল্লাহ! মহান আল্লাহ তোমার কবর শান্তিময় রাখুন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের বৈবাহিক জীবনে আমাদের মধ্যে একবারও ঝগড়া-বিবাদ হয় নি।’
একথা শুনে তাঁর এক ছাত্র অবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া শায়খ! এটা কিভাবে সম্ভব?’
জবাবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বললেন, ‘যখনই আমি তার প্রতি রেগে যেতাম তখন তিনি চুপ থাকতেন, আর যখন তিনি আমার প্রতি রেগে যেতেন তখন আমি চুপ থাকতাম। তাই আমাদের মধ্যে কখনোই ঝগড়া-বিবাদ হয় নি।
আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল। যা কিছু ভুল বলেছি আল্লাহ আমাদের স্মৃতি থেকে তা তুলে নিন। যা কিছু সঠিক বলেছি, আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ
ইসলাহী বয়ান অবলম্বনে।