As-Salamu Alaikum. Welcome to Our SQSF-স্মার্ট লাইব্রেরী এবং কাউন্সেলিং (আত্নশুদ্ধির) সফটওয়্যার_SQSF-Smart Library and Counseling Software. Reg No: S-13909 www.sqsf.org ফোনঃ 01764 444 731
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.
(০১ম পর্ব)
الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى
দারুল উলূম দেওবন্দ, উপমহাদেশের সেই সুবিশাল জ্ঞাননিকেতন যা গত শতাব্দীতে ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব জন্ম দিয়েছে। মুসলিম উম্মাহকে ফিকরী ও আমলী পথনির্দেশনা দান করে ইতিহাসে মজবুত অবস্থান ও সুদূর প্রভাব তৈরি করেছে।
দারুল উলূম দেওবন্দ কী?
তার প্রতিষ্ঠার কারণ কী?
কী অবদান রেখেছে দারুল উলূম?
এ সকল প্রশ্নের কাঙ্খিত উত্তরের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে এক শতাব্দী পূর্বের ঘটনায়। কারণ, ঐ সকল ঘটনা ও পরিস্থিতি দারুল দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দীপক। দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রেক্ষাপট সামনে রাখা হলে প্রকৃত অর্থে তাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব।
১৮৫৭ সালের আযাদীর লড়াই ছিল পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের থেকে হিন্দুস্তানকে মুক্ত করার মুসলমানদের শেষ প্রচেষ্টা। তখনকার মুসলমানদের দুর্বার আন্দোলন ব্রিটিশ শাসকদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, মুসলমান এমন জাতি যাঁরা শত বিপর্যয়ে অন্যের দাসত্বে তুষ্ট থাকে না। ফলে ইংরেজরা তাদের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করে ফেলে। এই সেই ব্রিটিশ, যারা লাখ লাখ মুসলমানদের রক্ত ঝড়িয়েছে, হাজার হাজার মুসলমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হিন্দুস্তানের নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছে, এরাই এখন মঙ্গলকামী হয়ে মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে চাইছে! উদ্দেশ্য ছিলো, যে জাতিকে বলপ্রয়োগ করেও গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যায় না, তাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে দেওয়া। যেন সে নিজেকে স্বতন্ত্র জাতি অনুভব করতে না পারে। নিজের ধর্মীয় বিধিনিষেধ, তাহযীব-সংস্কৃতি এবং সোনালী অতীত থেকে ধীরে ধীরে এত দূরে চলে যায় যে, এক যুগ পর সে তা স্মরণই করতে সক্ষম হবে না। কবি বলেন:
এ কেমন আকাশ, যেখানে শুধু একটি বিদীর্ণ তারকা!
তাদের মিশন সফলে সর্বাধিক ফলপ্রসূ ফর্মূলা ছিল, মুসলমানদের পাঠ্যসিলেবাসে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন যার দ্বারা মুসলমানদের মেধা-মস্তিষ্কে পশ্চিমা রাজত্বের প্রভাব বিস্তার করবে। এতে প্রভাবান্বিত হয়ে মুসলিম জাতি নিজের স্বাতন্ত্র-স্বকীয়তা নিয়ে ভাববার সুযোগই পাবে না। লর্ড মেকল হিন্দুস্তানের লোকদের জন্য একটি নতুন সিলেবাসের আবেদন করলেন। সে লক্ষ্যে এক দীর্ঘ পাঠ্যপরিক্রমা নির্বাচন করলেন। সেখানে ইসলামী ও সামাজিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিকৃষ্টভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। মুসলিম আলিমদের ব্যাপারে ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে। সবশেষে তিনি সুস্পষ্ট লিখেছেন:
“বর্তমানে আমাদের এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে, যারা আমাদের ও আমাদের স্বায়ত্ত্বশাসিত জনগণের মাঝে প্রতিনিধির কাজ আঞ্জাম দিবে। রক্তে, রঙ্গে তারা হবে হিন্দুস্তানি। কিন্তু চিন্তাচেতনা, বোধ-উপলব্ধি ও চরিত্রে হবে ইংরেজ।”
মুসলমানদের মেধাগত বিকারগ্রস্ত করে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার এ ষড়যন্ত্র মূলত হিন্দুস্তানে নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার বিকল্প মিশন। আযাদীর বিভিন্ন আন্দোলন-লড়াই এর সম্মুখে যা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। তোপ-কামান দিয়েও তা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না। মরহুম আকবর ইলাহাবাদী ইংরেজদের সুদূরপ্রয়াসী এ ষড়যন্ত্রকে একটি ছোট কবিতায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন:
তোপ ব্যর্থ হলো, আসল প্রফেসর, কুঠারে না পারায় নিলো রান্দা (বিশেষ অস্ত্র)
মুসলমানদের মাঝে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উলামায়ে হযরত সুদূরপ্রয়াসী এই ষড়যন্ত্রকে পূর্ণরূপে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাঁরা অনুভব করলেন, মুসলমানদের দীন ও ঈমান হেফাজতের জন্য এবার মজবুত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে কয়েক যুগ পর এ জাতি তার স্বকীয়তা খুইয়ে বসবে। কয়েক প্রজন্মের পর হয়তো ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত ব্যক্তিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলাম কী, ইসলামের ভিত্তিমূল বৈশিষ্ট্য কী- তারা জানবেও না!
এ পর্যন্ত সে সকল উম্মাহদরদী দুরদৃষ্টিসম্পন্ন উলামায়ে কেরাম বৃটিশ আধিপত্যকে বিদায়ের লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিলেন। সে লক্ষ্যে তাঁরা আযাদীর বিভিন্ন আন্দোলন ও লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ইংরেজরা যখন তোপ-কামানের পথ পরিহার করে এক গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে, তখন সে সকল উলামায়ে কেরাম যারা নিজের জীবন বাজি রেখে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছেন, তারাও নিজেদের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করেছেন। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের জবাব যুগান্তকারী কৌশলে দিয়েছেন। ইংরেজদের বিষমিশ্রিত নতুন পাঠ্যসিলেবাস থেকে মুসলিম জাতিকে নিরাপদ রাখার তাদের সামনে একটিই পদ্ধতি ছিলো যে, মুসলমানদের পক্ষ থেকেও এমন সিলেবাস ও প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যেখানে ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রদান করা হবে।
তৎকালীন বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম এ কাজে নিজেদের সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা ব্যায় করেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ কাসিম নানুতুবী রাহ., হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. এবং হযরত হাজী সাইয়িদ আবিদ হুসাইন রাহ. ছিলেন ১৮৫৭ এর আযাদী লড়াইয়ের সম্মুখসারির নেতৃবৃন্দ। ইউপি এর একটি ছোট জায়গায় নিয়মতান্ত্রিক তাঁরা ইসলামী হুকুমতও কায়েম করেছিলেন। যদ্দরুন ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিতে তাঁরা ছিলেন দাগী আসামী। কিন্তু যখন দীন ও ঈমানের হিফাজতের লক্ষ্যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে আসল তখন তাঁরা দেওবন্দ গ্রামে একটি দীনা মাদরাসার ভিত্তি রাখলেন। সেই ঐতিহাসিক দীনী মাদরাসাটি আজকের দারুল উলূম দেওবন্দ।
তখনকার সময়ে উপমহাদেশে দীনা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অর্থই হলো বিভিন্ন মুসীবত ও পেরেশানীকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো। সুলতান মুহাম্মাদ তুঘলকের শাসনামলে যেখানে শুধু দিল্লীতেই এক হাজারের অধিক মাদরাসা ছিল, ইংরেজদের আধিপত্যের পর একটি মাদরাসাও সেখানে বাকী রইলো না। আযাদী লড়াইয়ে শামিল হওয়ার অপরাধে উলামায়ে কেরামকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হলো অথবা কালাপানি নির্বাসে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আর অন্য উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান করছিলেন। তাঁদের উপরও গ্রেফতারীর খড়গ ঝুলছিল। এ সকল কঠিন পরিস্থিতির কারণে শহরের চেয়ে দেওবন্দ গ্রামকে দীনী মাদরাসার জন্য তাঁরা উপযোগী মনে করেন। কয়েকজন মান্যবর উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে এ দীনী আন্দোলনের শুভসূচনা হয়।
এ দীনী দরসগাহ স্থাপনের মূলভিত্তিই ছিলো লর্ড মেকালের মিশনকে ব্যর্থ প্রমাণিত করা। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রজন্ম পরম্পরায় পৌঁছে দেওয়া। এবং আলেমদের এমন এক প্রজন্ম গড়ে তোলা যারা নাযুক থেকে নাযুকতর পরিস্থিতেও দীন ও ঈমানের হেফাযত করবে এবং পরবর্তীদের নিকট তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানগণ ইলহাদ, ও দীন পরিত্যাগের পশ্চিমা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করবে। ফলে যখনই পশ্চিমাদের আধিপত্য থেকে মুসলমানগণ স্বাধীন হবেন তখন ইসলামী বিধানব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হয়ে যাবে। যেহেতু পূর্ব থেকে ইসলামের সঠিক রূপরেখার সাথে তারা পরিচিত। এভাবে তারা নিজেদের ভবিষ্যত নির্মান করতে সক্ষম হবে।
১৫ মুহাররাম ১২৮৩ হি. মোতাবেক ৩০ মে ১৮৬৭ ঈ. তারিখে অত্যন্ত সাদামাটা ব্যবস্থাপনায় এ মহান দীনী দরসগাহর শুভসূচনা হয়। এই দীনী দরসগাহর প্রতিষ্ঠাতাদের যেহেতু মূল লক্ষ্যই ছিলো দীন ও ঈমানের একনিষ্ঠ খেদমত, তাই এ প্রতিষ্ঠার কথা কোথাও প্রচার করা হয়নি, নিয়মতান্ত্রিক কোনো বোর্ড গঠন করা হয়নি, যশ-খ্যাতি কুড়ানোর কোনো পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়নি। আল্লাহর কিছু একনিষ্ঠ বান্দা দেওবন্দ নামক ছোট্ট গ্রামে, একটি ছোট্ট মসজিদে যাকে ছাত্তা মসজিদ বলা হয়, একটি আনার গাছের ছায়ায় জীবনপ্রসবিনীর এ ধারা চালু করেন। এই মহৎ ও মহান কাজ আঞ্জামে কার্যকরী ব্যক্তি ছিলেন দু’জন। একজন শিক্ষক অপরজন ছাত্র। উভয়জনের নাম ছিল মাহমূদ। মোল্লা মাহমূদ দেওবন্দী ছিলেন শিক্ষক। মীরাঠ থেকে তাদরীস ও শিক্ষকতার জন্য যাকে নিয়ে আসা হয়েছে। ছাত্র ছিলেন দেওবন্দ গ্রামের যুবক মাহমূদ হাসান। পরবর্তী সময়ে যিনি শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রাহ. নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। যিনি রেশমী রুমাল আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ হুকুমতের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
চলবে…
(মাকালাতে মুফতী আযম, হাফিয আকবর শাহ বিন্নাসিত পৃ. ৪৫)
ইবরাহীম আবদুল্লাহ অনূদিত