গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি করেছে। বিশেষ করে মোবাইল প্রযুক্তিতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে ২০২২ সালের সর্বশেষ মে মাসের তথ্যনুসারে বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। এর আগে করোনাপূর্ব সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩৮ শতাংশ। করোনা আঘাত না হানলে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ পেরিয়ে যেত বলে ধারণা করছেন এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র স্মার্টফোনের ব্যবহার। এই স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, তাদের যেকোনো কাজ সম্পাদন করতে কোনো না কোনো অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্য নিতে হয়। আর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সাধারণত গুগল প্লে স্টোর ইনস্টল করা থাকে। সেখান থেকে ইচ্ছে আর চাহিদা অনুযায়ী যে কেউ, যে কোনো অ্যাপস ডাউনলোড করে ইনস্টল করতে পারবেন।
এবার একটি প্রশ্নে আসি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ কোনটি? বাংলাদেশে কোন অ্যাপের ব্যবহারকারী সবচেয়ে বেশি হয়? ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম নাকি অন্য কোনো অ্যাপ্লিকেশন? কথাটি'র উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয় কারণ বর্তমানে দেশে সবগুলো অ্যাপ'ই সমানতালে জনপ্রিয়। আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু দেশের জনপ্রিয় মোবাইল এপ্লিকেশন ইউটিউব নিয়ে। কারণ আমাদের শিশুদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইউটিউব অ্যাপস'টি।
শিশু-কিশোরদের হৃদয় জায়গা করে করে নেওয়া এই ইউটিউব বাংলাদেশে গত একদশকে জনপ্রিয়তা পেলেও সান ব্রুনো, ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক এই মার্কিন অনলাইন ভিডিও প্ল্যাটফর্ম সেবার সাইট ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। যা বর্তমান বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাবশালী অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বর্তমানে অধিকাংশ মা-বাবা তাদের সন্তান কে ঘরবন্দী করে রাখার কৌশল হিসেবে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, নোটবুক, ট্যাব অথবা ল্যাপটপ। এসব ডিভাইস ব্যবহার তারা সহজে ঢুকে যাচ্ছে অনিরাপদ সাইবার দুনিয়া'য়। শিশুদের ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনগুলোর ব্যবহার তুলনামূলকভাবে ইউটিউবের চেয়ে একটু কঠিন। ইউটিউব ব্যবহারের সহজলভ্য হওয়ার কারণে হাতে স্মার্ট ফোন থাকলে যে কেউ সহজে এখান থেকে সবধরনের ভিডিও দেখতে পারেন। এভাবে দেশবিদেশের শিশু-কিশোরদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইউটিউব। ব্যবহারের এই সহজলভ্যতা'ই তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ।
বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন এমনটা খুব বেশিদিন আগেও লক্ষ করা যায়নি। তবে বর্তমানে শিশু-কিশোরদের মাঝে এমনকি অবুঝ শিশুদের স্মার্ট ফোন কিংবা ট্যাবে'র ব্যবহার মারাত্মক আকারে বেড়েছে। এর দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন না অভিভাবকেরা। অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের শিশুদের সামাল দেয়ার জন্য স্মার্ট সাহায্য নেন। তারা সন্তানদেরকে সময় কম দেওয়া এবং শিশুদের কান্না থামাতে স্মার্ট ফোনের ইউটিউবের অ্যাপের বিভিন্ন কার্টুন কন্টেন্ট দেখিয়ে শান্ত রাখার এই কৌশলই এক সময়ে অভিভাবকদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
ইদানীংকালে করোনা'র পর শিশু-কিশোরদের মাঝে স্মার্ট ফোনের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনা অতিমারি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে শিশুদের ওপর। শুধু বাংলাদেশে নয়! শিশুদের জন্য কাজ করে যাওয়া সংস্থা ইউনিসেফ'র তথ্যনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর রোজ এক লাখ ৭৫ হাজার শিশু ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছে। সর্বশেষ মহামারি করোনার কারণেই অনেক
শিশু-ই তাদের শৈশব হারিয়েছে, হারিয়েছে স্বাভাবিক বিকাশের গতি, লেখাপড়ার সুযোগ। অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার জন্য অভিভাবকেরা স্মার্ট ফোন হাতে তুলে দিয়েছেন আর এই সুযোগে কোমলমতি শিশুরা চলে যাচ্ছে এক অনিরাপদ গন্তব্যে যার নাম সাইবার দুনিয়া। ইউটিউবে তারা মজার মজার সব কার্টুনসহ নানান মজাদার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের ফাঁকে নিজের অজান্তেই দেখতে বিভিন্ন নেতিবাচক ভিডিও। যা তাদের সাধারণ মন-মস্তিষ্কে চিন্তা চেতনায় ওপর এক অদৃশ্য প্রভাব ফেলছে।
নিজেদের সাইটে শেয়ারিং এসব নানান নেতিবাচক ভিডিওগুলো যে শিশুবান্ধব নয় তা ইউটিউব কর্তৃপক্ষ নিজেই আচ করতে পেরেছে। বিষয়টি মাথায় রেখে প্রথমে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের জন্য এবং পরবর্তীতে তা পুরো বিশ্বের শিশুদের উপযোগী আরেকটি অ্যাপ চালু করে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ। 'ইউটিউব কিডস' নামের অ্যাপটিতে শিশুরা কোন ধরনের ভিডিও কতক্ষণ দেখবে, তাও নির্ধারণ করতে পারেন অভিভাবকরা। অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে চলা অ্যাপটিতে রয়েছে ভিডিও আপলোডের বিধিনিষেধও। ফলে চাইলেই সাইটটিতে কোনো ভিডিও আপলোড করা যাবে না। তবে অ্যাপটিতে শিশুদের 'অনুপযুক্ত' কনটেন্ট রয়েছে- এ অভিযোগ এনেছে শিশুদের কল্যাণে কাজ করা মার্কিন সংগঠন 'ক্যাম্পেইন ফর এ কমার্শিয়াল-ফ্রি চাইল্ডহুড' এবং 'সেন্টার ফর ডিজিটাল ডেমোক্রেসি'। এ বিষয়ে দেশটির ফেডারেল ট্রেড কমিশনের কাছে অভিযোগও করেছে তারা। শিশুদের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া মার্কিন সংগঠন 'ক্যাম্পেইন ফর এ কমার্শিয়াল-ফ্রি চাইল্ডহুড' এবং 'সেন্টার ফর ডিজিটাল ডেমোক্রেসি'র অভিযোগের সূত্র ধরেই বলা যায় যে ভিডিও বিনিময়ের জনপ্রিয় সাইট ইউটিউবের দুটি সংস্করণেরই ভিডিও গুলো শিশুদের জন্য উপযোগী নয়।
ইউটিউবে'র ভিডিওগুলো যে শিশুদের জন্য কতটা নেতিবাচক তা স্পষ্ট বুঝা যায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে। এবছরেরই মে মাসে দেশের সকল শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ করে যে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজারে ইউটিউবে দেখে ‘বোমা’ তৈরির চেষ্টাকালে তিন শিশু আহত হয়েছে। তারা কৌতুহলবশত বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য দিয়ে বোমা তৈরির চেষ্টা করে। কিন্তু প্লাস্টিকের বোতলে দাহ্য পদার্থ ঢোকানো মাত্রই বিস্ফোরিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারা। বিষয়টি দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি সৃষ্টি করেছিল। যদিও তারা বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু দেশে এই ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে গণমাধ্যমে যেগুলোর খবর আসে আমরা সেগুলোই জানতে পারি! আর বাকি সব থাকে অজানা।
মাঝে মধ্যে এমন খবরও গণমাধ্যমে আসে যে ইউটিউবে ভারতীয় সনি টিভির সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোলের অপরাধ মূলক বিভিন্ন কনটেন্ট দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণেরা বিভিন্ন কিশোর অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয় বর্তমানে ইউটিউব দেখে শিশুদের মধ্যে নানাবিধ বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে, এমনকি অতি অল্প বয়সেই তারা অ্যাডাল্ট বিভিন্ন কনটেন্ট দ্বারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। সচেতন অভিভাবকদের এখনই সময় ভাবার যে তাদের শিশু সন্তানদের জন্য ইউটিউব কতটা নিয়ামক।
ইউটিউবের নেতিবাচক দিক নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন ইউটিউবের অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ইউটিউবের কল্যাণে বাংলাদেশসহ বিশ্বে অনেক মানুষের জীবন বদলে গেছে। ইউটিউবের ব্যবহারের সহজলভ্যতা সহ নানাদিক বিবেচনা করলে এটাই বুঝাযায় যে বর্তমান বিশ্বে ইউটিউবের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো ভিডিও শেয়ারিং সাইট কেউ তৈরি করতে পারেনি। এবং যেগুলো ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে সেগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে ইউটিউবের জনপ্রিয়তা ও সহজলভ্য ব্যবহার আমাদের শিশুদের জন্য কখনো নিরাপদ নয়। তাদের শিশুদের জন্য তৈরি 'ইউটিউব কিডস'ও আমাদের তেমন আশা জাগায়'নি। তবে আশা জাগানোর খবর হলো বাংলাদেশের কয়েজন প্রযুক্তিবিদ ও তরুণ শিক্ষার্থী মিলে তৈরি করেছেন শিশুদের জন্য নিরাপদ ভিডিও শেয়ারিং সাইট ‘বেবিটিউব’। তারা শিশু ও কিশোরদের নিরাপদে অনলাইনে ভিডিও দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। ইউটিউবের আদলে তৈরি ভিডিও শেয়ারিং দেশীয় এই সাইট'টি প্রথম দিকে তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও দিনদিন এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের দাবি এই অ্যাপস শিশুদের জন্য শতভাগ নিরাপদ। তার মূল কারণ বেবিটিউবে শিশুতোষ ভিডিও কন্টেন্ট ছাড়া অন্য কোনো কন্টেন্ট আপলোড করা যায় না। বেবিটিউবে শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ, মজাদার এবং শিক্ষণীয় ভিডিও শেয়ার করার সুযোগ তৈরি করেছে। অ্যাপের পাশাপাশি সেবা পাওয়া যাবে বেবিটিউবের ওয়েবসাইটেও। একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে খেলাধুলা, কার্টুন, পড়াশোনা, মুভি, নাটক, গেম, গান, গজল, ট্রাভেল, ব্লগ, টেকনোলজিসহ শিশু-কিশোরনির্ভর সব ধরনের কনটেন্ট।
তাদের পরিকল্পনা প্রতিটি শিশু-কিশোর প্রযুক্তির দুনিয়ায় সুস্থ থাকুক। সেই সুস্থতা নিশ্চিত হোক বেবিটিউবের মাধ্যমে।
বর্তমান সময়ে অনেকেই আছেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী। ব্যস্ততা ও বাস্তবতা'র জন্য অনেক দম্পতি-ই তাদের সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। প্রযুক্তির এ যুগে সন্তানদেরকে ইউটিউব কিংবা ইন্টারনেটের অন্যান্য ব্যবহার থেকে দূরে রাখাও কঠিন। আবার দেশে এখনও শিশু-কিশোরদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ইন্টারনেট জগৎ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সুতরাং অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের কাছে আরও আন্তরিক, বন্ধুসুলভ, কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। অবসরে সন্তানদের সময় দেওয়া, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, সুযোগ থাকলে মাঠে খেলার সুযোগ করে দেওয়া, বন্ধুদের সাথে মিশার সুযোগ দেওয়া, পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে আড্ডার সুযোগ, ধর্মীর অনুশাসন মেনে চলার প্রতি উৎসাহ দেওয়া উচিত। এবং নির্ধারিত একটা সময় পর্যন্ত শিশুদের কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সংস্পর্শে আসতে দেবেন না। বাসায় স্মার্ট টিভি থাকলে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন। স্মার্ট ফোন হাতে দিয়ে শিশুদের একা রেখে কোথাও যাবেন না। শিশুদের সামাল দেয়ার জন্য স্মার্ট ফোনের সাহায্য নেওয়া বন্ধ করুন। কমপক্ষে এসএসসি পরিক্ষার পূর্বে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন দেওয়া উচিত নয়। নিজের সন্তানকে কোনো পিতামাতাই চোখে চোখে রাখা যেমন সম্ভব নয় তেমনি প্রযুক্তির এ যুগে শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। তাই বলে প্রযুক্তিতে অবাধ বিচরণের সুযোগ প্রদান করাও ঠিক নয়।
লেখক: ডি এইচ মান্না
ফ্রিল্যান্স গণমাধ্যমকর্মী